ইতালির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মনফালকোনে শহরে একটি ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং পৌর কর্তৃপক্ষের মধ্যে বিরোধের জের ধরে শহরটিতে বসবাসরত মুসলিমদের একত্রিত হয়ে নামাজ পড়ার কোনও জায়গা রইল না
ইউরোপ ডেস্কঃ মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত অভিবাসন বিষয়ক গণমাধ্যম ইনফোমাইগ্রেন্টসের বাংলা বিভাগ এতথ্য জানায়। গণমাধ্যমটির এক প্রতিনিধি শহরটির ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত একজনের সঙ্গে দেখা করেছেন। সেখানে নামাজ পড়া বন্ধ হওয়ার আগে তিনি ইমাম ছিলেন।
তিনি বলেন, ‘‘আমার নাম মিজানুর রহমান৷ আমি বাংলাদেশে জন্মেছি, আর এখন ইতালির গোরিজিয়া প্রদেশের মনফালকোনেতে থাকি। আমি ২০১৪ সালের ১০ জুন ইতালিতে এসেছি। এখানে প্রায় ১১ বছর ধরে আছি ৷’’
এক দেখায় যে কোনও কারো কাছে রহমানকে ইমাম মনে হতে পারে৷ তার সূক্ষ্ম নকশা করা কালো ও সোনালি কুফি টুপি এবং লম্বা সাদা পাঞ্জাবি ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্য অবশ্য খুবই স্বাভাবিক পোশাক। কিন্তু তার মুখ ভর্তি দাড়ি এবং আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি—একটি সোনালি খিলানের সামনে, একটি লম্বা ফাঁকা ঘরে, যা নামাজের জন্য একেবারে উপযুক্ত—এসব মিলিয়ে তাকে ইমাম বলে মনে হতে পারে।
কিন্তু রহমান জোর দিয়ে বলেন, এটি তার পদবি নয় এবং তাকে এভাবে অভিহিত করাও ঠিক হবে না। তবে, সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটি যখন চালু ছিল, তখন তিনি ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আরও অনেক বাংলাদেশি সহকর্মীদের সঙ্গে তিনি এখন মনফালকোনেতে জাহাজ কারখানায় কাজ করছেন।
তার পরিবার এখনও বাংলাদেশেই থাকেন। তিনি বেশ গৌরবের সঙ্গেই তার মোবাইলে থাকা একটি ভিডিও আমাদের দেখান। যেখানে তার মেয়ে ইংরেজিতে কথা বলছিলেন। ওই সময় ‘দারুস সালাম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ নামে পরিচিত জায়গাটি ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন তিনি।
কেন্দ্রের কার্যক্রম নিয়ে তদন্ত: যেদিন আমরা সেখানে গিয়েছিলাম, কেন্দ্রটি ছিল একেবারে ফাঁকা। কেন্দ্রটি নিয়ে ২০২৩ সাল থেকে সমস্যার শুরু হয়। ওই সময় শহরটির মেয়র ছিলেন আনা মারিয়া চিসিন্ত। বর্তমানে তিনি অভিবাসনবিরোধী লিগ পার্টি (লা লেগা) দলের সদস্য এবং বর্তমানে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এমইপি(MEP)। তিনি ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটিকে নামাজের জায়গা হিসেবে ব্যবহারের বিরোধিতার পাশাপাশি একাধিক তদন্ত শুরু করেন।
চলতি বছরের জুলাইয়ে ফেসবুকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই ব্যাখ্যা করেন, তদন্তের মাধ্যমে পৌর কাউন্সিল জানতে পারে সম্পত্তিটি বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য নিবন্ধিত এবং নির্ধারিত। তাই এটি নামাজের জায়গা হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না৷ বিভিন্ন তদন্তের সময় কর্তৃপক্ষ আরো উল্লেখ করেছিল যে,ওই কেন্দ্রটি ঘিরে নিরাপত্তা এবং অগ্নিঝুঁকির শঙ্কা রয়েছে।
এ বছরের জুলাইয়ে ত্রিয়েস্তের একটি ট্রাইব্যুনালে মামলাটির শুনানি হয়। আদালত জানিয়েছে, মনফালকোনে পৌরসভা আইন অনুযায়ী শাস্তি দিতে এবং সম্পত্তি পুনরায় দখল করতে পারে, কারণ কেন্দ্রটি এমন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছিল, যার জন্য এটি নিবন্ধিত বা নির্ধারিত ছিল না।
বর্তমানে মনফালকোনের নেতৃত্বে রয়েছেন মেয়র লুকা ফাসান। তিনিও ডানপন্থিদের সমর্থনে নির্বাচিত হয়েছেন। এমনকি লিগ পার্টিও তাকে সমর্থন দিয়েছে।
আনা মারিয়া চিসিন্ত মনফালকোনের বাসিন্দা এবং তিনি নিয়মিত তার নিজ শহরে যান, রাজনৈতিক প্রচারে অংশ নেন। ডানপন্থি এই রাজনীতিবিদন এখন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য।
ইটালীয় সংস্কৃতি রক্ষা’: ইউরোপীয় পার্লামেন্টেও নিজের ডানপন্থি অবস্থান ধরে রেখেছেন চিসিন্ত। গত ২ ও ৩ ডিসেম্বর নিজের এক্স অ্যাকাউন্ট থেকেই তিনি এই ধরনের পোস্ট করেছেন। এক্স পোস্টে তিনি দাবি করেছেন, ‘‘চিরচেনা দৃশ্যগুলো বদলে যাচ্ছে’’ আর সেখানে ‘‘অপ্রয়োজনীয় মসজিদ’’ গড়ে উঠছে। এবার পাদুয়া (পাদোভা)-তে ‘‘ক্রিসমাস আক্রমণের মুখে পড়েছে।’’
আঞ্চলিক টিভি চ্যানেল অ্যান্টেনা থ্রি-এর (এটি ইতালির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সম্প্রচারিত হয়) ‘রিঙ’ অনুষ্ঠানে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে চিসিন্ত ‘‘উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধ’’ নিয়ে কথা বলেন এবং ‘‘ইতালীয় মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি’’ রক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেন।
এক্স পোস্টে চিসিন্ত ‘রিমাইগ্রেশন’-এর পক্ষে জনমত তৈরিতেও আহ্বান জানিয়েছেন। গত ২৭ নভেম্বর একটি পোস্টে তিনি অভিযোগ করেন, একজন ‘‘বাংলাদেশি [অভিবাসী] একটি অভ্যর্থনা শিবিরে ১০ বছরের একটি কন্যাশিশুকে ধর্ষণ করেছে এবং তাকে সন্তান সম্ভবা করে দিয়েছে।’’
এই পোস্ট সম্পর্কিত মন্তব্যে চিসিন্ত একজন ব্যক্তির ঘটনা দিয়ে পুরো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন এবং বহুবচনে লেখেন: ‘‘এই চরিত্রগুলো/পশুরা অভ্যর্থনা শিবিরে মেয়েদের ধর্ষণ করে!’’ বর্তমানে আদালতের নির্দেশে কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ফাঁকা পড়ে আছে মনফালকোনের এই ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটি।
কবির আহমেদ/ইবিটাইমস






















