ইউরোপ ডেস্কঃ জার্মানিতে বসবাসরত শরণার্থীদের একটি বড় অংশ এখনও দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে রয়েছেন। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধীরে ধীরে এই অবস্থার কিছুটা উন্নতি হচ্ছে বলে ইঙ্গিত মিলেছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
জার্মানির ইকোনমিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ডিআইডাব্লিউ)-এর গবেষণা বলছে, নিজ দেশ থেকে পালিয়ে জার্মানিতে আশ্রয় নেওয়া মানুষের একটি বড় অংশ দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে রয়েছেন।.২০২২ সালে শরণার্থীদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ (৬৩.৭ শতাংশ) এই ঝুঁকিতে ছিলেন। ২০২০ সালে এই হার ছিল সর্বোচ্চ—৭০ শতাংশ।
যার বা যাদের আয় জার্মানির পারিবারিক গড় আয়ের ৬০ শতাংশের নিচে থাকে, তাকে বা তাদেরকে দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। দেখা গেছে, শরণার্থীরা সাধারণ মানুষের তুলনায় দারিদ্র্যের ক্ষেত্রে অনেক বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন।
ডিআইডাব্লিউ-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সাল থেকে সামগ্রিকভাবে নিম্ন-আয়ের মানুষের হার স্থির রয়েছে, তবে ১৯৯৫ সাল থেকে সাধারণ জনগণের মধ্যে এই হার ক্রমশ বেড়েছে।
এই দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতার পেছনে জনসংখ্যাগত পরিবর্তন, বিশেষ করে অভিবাসনের প্রভাব রয়েছে বলে মনে করে ডিআইডাব্লিউ। গবেষকরা জোর দিয়ে বলেছেন, শরণার্থীদের শ্রমবাজারে সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্তিই হতে পারে দারিদ্র্য ঝুঁকি কমানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ। জার্মানির মোট জনসংখ্যার চার শতাংশই শরণার্থী।
জার্মানি ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক রিসার্চ জানিয়েছে, অভিবাসীদের মধ্যে, বিশেষ করে শরণার্থীদের মধ্যে নিম্ন-আয়ের পরিবারের সংখ্যা ‘‘গড়ের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি, যেখানে অভিবাসন-অতীত নেই এমন ব্যক্তিদের মধ্যে এই হার গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে।’’
সম্প্রতি, অভিবাসন-অতীত রয়েছে এমন ব্যক্তিদের অন্তত ১৩ শতাংশকে দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে থাকা মানুষ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে। তুলনামূলকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের মধ্যে নিম্ন-আয়ের হার প্রায় ২৬ শতাংশ।
গবেষকেরা এই নিম্ন-আয়ের মানুষের উচ্চ সংখ্যাকে ব্যাখ্যা করেছেন কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ হিসেবে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে: ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা, পেশাগত যোগ্যতার স্বীকৃতি পেতে দেরি হওয়া এবং জার্মানিতে পৌঁছার পর বেকারত্ব বা কর্মসংস্থান খুঁজে পেতে দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষা। এসব কারণেই স্থানীয়দের তুলনায় শরণার্থীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে কম। এ কারণেই শরণার্থীদের মধ্যে দারিদ্র্যের ঝুঁকি বেশি বলে মনে করছেন তারা।
তবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শরণার্থীরাও নিয়মিত কর্মসংস্থানে যুক্ত হচ্ছেন। জার্মানির ফেডারেল এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সাল থেকে শরণার্থীদের মধ্যে কর্মসংস্থানের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, বিশেষ করে লজিস্টিকস, স্বাস্থ্যসেবা, আতিথেয়তা খাতে তাদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। সম্প্রতি শরণার্থীদের মধ্যে দারিদ্র্যের ঝুঁকি তুলনামূলক কিছুটা কমে আসার প্রধান কারণ হিসেবে শ্রমবাজারে ক্রমবর্ধমান অন্তর্ভুক্তিকেই চিহ্নিত করেছেন ডিআইডাব্লিউ-এর গবেষক মার্কুস গ্রাবকা।
জার্মানিতে দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে বেশি ভুগছেন নারীরা, বিশেষ করে শরণার্থী ও সিঙ্গল মায়েরা। ডিআইডাব্লিউ- এর প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে থাকার বিষয়টি অভিবাসন-অতীত এবং শ্রমবাজারে সীমিত অংশগ্রহণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। গবেষণাটি বলছে, যেসব পরিবারে কোনো সদস্য শ্রমবাজের যুক্ত নন, সেখানে দারিদ্র্যের হার ৭০ শতাংশেরও বেশি। আর যেসব পরিবারে দুই জন উপার্জনকারী রয়েছেন, সেখানে এই হার ছয় শতাংশের নিচে।
নারী শরণার্থীরা সাধারণত এমন পরিবারের বসবাস করেন, যেখানে একজন মাত্র আয় করেন। কখনও কখনও নারীদের কেউ কেউ খণ্ডকালীন কাজেও যোগ দেন৷ শিশুর যত্ন-আত্তি, ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা কিংবা যোগ্যতার স্বীকৃতির কারণে তারা শ্রমবাজারের বাইরে থেকে যান৷ সামগ্রিক আয় বৈষম্য স্থিতিশীল থাকলেও কাঠামোগত এসব অসুবিধার কারণে, অভিবাসন-অতীত রয়েছে এমন নারীরা এখনও নিম্ন-আয়ের শ্রেণিতে আটকে আছেন।
২০২১ সাল থেকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে তাদের ক্রয়ক্ষমতা আরো কমে গেছে। এতে শরণার্থী নারীদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের ব্যবধান বেড়ে গেছে৷ ডিআইডাব্লিউ-এর গবেষণা অনুযায়ী, নারীদের শ্রমবাজারে প্রবেশের সুযোগ তৈরি হলে — যেমন শিশু যত্ন-আত্তিতে সহায়তা, যোগ্যতার স্বীকৃতি, এবং ভালো মজুরির প্রণোদনা দেয়া হলে — দীর্ঘমেয়াদে দারিদ্র্য ও বৈষম্য কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে থাকা মানেই যে কেউ চরম দারিদ্র্যে বসবাস করছেন, তা নয়। তবে, এই অবস্থা আবাসন, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবাসহ সামগ্রিকভাবে সমাজে সীমিত অন্তর্ভুক্তিকেই প্রতিফলিত করে।
এই কারণে সামাজিক সংগঠনগুলো ভাষা শিক্ষায় আরো বেশি বিনিয়োগ, বিদেশি যোগ্যতার দ্রুত স্বীকৃতি, এবং শ্রমবাজারে অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া সহজ করার আহ্বান জানিয়েছে। এতে টেকসই আয়ের সম্ভাবনা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে মনে করছে সংগঠনগুলো।
বিশেষজ্ঞরা দারিদ্র্যকে শুধু ব্যক্তিগত সমস্যা হিসেবে দেখার ক্ষেত্রে আপত্তি করছেন। ডিআইডাব্লিউ-এর গবেষণায় বলা হয়েছে, দক্ষ কর্মসংস্থানে প্রবেশের সুযোগ না থাকা, স্থানীয় শ্রমবাজারের অবস্থা বিবেচনায় না নেয়া এবং কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই শরণার্থীদের বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করে দেয়ার মতো কাঠামোগত বিষয়গুলো আয় বৈষম্য তৈরি করছে।
কবির আহমেদ/ইবিটাইমস