ইলা মিত্রের ৯৯তম জন্মবার্ষিকী আজ

তেভাগা আন্দোলনের সব স্মৃতিই যেন ‘বিস্মৃতি’

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি: ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের বিপ্লবী নেত্রী ইলা মিত্রের ৯৯তম জন্মবার্ষিকী আজ শুক্রবার। দিনটি উপলক্ষে স্থানীয় সংগঠন ‘ইলা মিত্র জন্মবার্ষিকী উদযাপন পরিষদ’ কর্মসূচি পালন করবে। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে নেই কোনো আয়োজন। স্থানীয়দের আক্ষেপ,‘এমন বড় একটি আন্দোলন যে হয়েছিল,তার কোনো নামনিশানাই পাওয়া যাবে না কিছুদিন পরে। এই সংগ্রামীর স্মরণ ও স্মৃতি সংরক্ষণে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নেওয়ার দাবি তাদের।’

ঝিনাইদহের শৈলকুপার ভূমিকন্যা,তেভাগা আন্দোলনের কিংবদন্তি নেত্রী,নাচোলের রাণী মা ইলা মিত্র ১৯২৫ সালের এদিনে তিনি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের অধিন বাংলার একাউটেন্ট জেনারেল। চাকরিসূত্রে তিনি সেসময় কলকাতায় অবস্থান করছিলেন।

ইলামিত্রের জন্ম ও বেড়ে ওঠা কলকাতায় হলেও তার পৈত্রিকবাড়ি শৈলকুপা উপজেলার নিত্যানন্দপুর ইউনিয়নের বাগুটিয়া গ্রামে। শৈশব ও কৈশোরের অনেক সময় কেটেছে তার ঝিনাইদহের বাগুটিয়া গ্রামের রায়পাড়ার বাড়িতে। শৈলকুপা উপজেলা সদর থেকে দক্ষিণে ১৩ কিলোমিটার দূরে বাগুটিয়া গ্রামে কাচা রাস্তার ধারে ইলামিত্রের বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন এর পৈত্রিক দোতলা বাড়িটি এখনও কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। চুন-সুড়কি দিয়ে গাঁথা ৯ কক্ষবিশিষ্ট দালানটি ইতিহাসের সাক্ষী হলেও তা রয়েছে অন্যের দখলে।

শুধু বাড়ি নয়, ইলামিত্রের বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন এর রেখে যাওয়া প্রায় শত বিঘা জমিও ভোগদখল করছেন দখলদাররা। দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় বাড়িটির বেহাল অবস্থা। ভেঙে ফেলা হচ্ছে সুরম্য ইটের গাঁথুনি ও ভিতগুলো। অযত্ন অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে সংগ্রামী এ কৃষকনেতার স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি। কারুকার্যখচিত বাড়িটির জানালা দরজাসহ দেয়ালের পলেস্তরা খসে পড়ছে। তার স্মৃতি সংরক্ষণে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি তেমন কোনো উদ্যোগ। এমনকি তার জন্ম-মৃত্যু দিবসে নেয়া হয়না কোনো কর্মসূচি।

জন্মের সময় ইলামিত্রের নাম ছিল ইলা সেন। ১৯৪৫ সালে চাপাইনবাবগঞ্জের রামচন্দ্রপুরের জমিদার বাড়ির ছোটছেলে দেশকর্মী কমিউনিস্ট নেতা রমেন্দ্রনাথ মিত্রের সাথে তার বিয়ে হয়,রমেন্দ্রনাথ মিত্র মালদহের রামচন্দ্রপুর হাটের জমিদার মহিমচন্দ্র ও বিশ্মামায়া মিত্রের ছোট ছেলে। বিয়ের পর তার নাম হয় ইলা মিত্র। বিয়ের পর ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত চাপাইনবাবগঞ্জে তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি। জমিদার পুত্রবধু হয়েও বাংলার শোষিত বঞ্চিত কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি সংগ্রাম করতে গিয়ে হয়ে ওঠেন কৃষক নেতা ও সাঁওতালদের রাণী মা।

এসময় তিনি কয়েকবার জেল খাটেন। ভোগ করেন অমানুষিক  নির্যাতন। তিনি আজীবন কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করে গেছেন। ইলামিত্রের স্মৃতিবিজড়িত ঝিনাইদহের শৈলকুপার পৈত্রিক ভিটা ও স্মৃতি সংরক্ষণে শৈলকুপায় ‘ইলামিত্র স্মৃতিরক্ষা আন্দোলন’ নামে একটি সামাজিক সংগঠন গঠিত হয়েছে। সংগঠনের উদ্যোগে জন্ম-মৃত্যুদিবসে মানববন্ধন, র‌্যালী, আলোচনাসভা করা হয়ে থাকে। জেলা পর্যায়েও ইলামিত্র স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ নামে একটি সংগঠন আছে। বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য তারা কয়েকবছর আগে জেলা প্রশাসক বরাবর একটি স্মারকলিপি  প্রদান করে। বিভিন্ন সময় এ ব্যাপারে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির ফলে ৪ জানুয়ারি ২০১৭ তারিখে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহকারি সচিব মোঃ জিয়াউদ্দিন ভূইয়া স্বাক্ষরিত ৪৩.০০.০০০০.১১৪.০২৭.১১২.১৪/০১ (১) নং স্মারকে সরকারের প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর বাড়িটি সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর জেলা প্রশাসককে নির্দেশ প্রদান করা হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও এ ব্যাপারে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।

তৎকালীন ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী  কর্মকর্তারা কয়েকবার বাড়িটি পরিদর্শন করেছেন। কিন্তু আজ অবধি বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য তেমন কোনো কর্মদ্দ্যোগ দেখা যায়নি। ইলামিত্র স্মৃতি রক্ষা আন্দোলনের নেতারা মনে করেন বাড়িটি সংরক্ষণ করা হলে এটি দর্শনার্থীদের জন্য পর্যটন স্থান হতে পারে। রক্ষা পাবে বাড়িটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব।

বাগুটিয়া জরিপ বিশ্বাস কলেজের অধ্যক্ষ সুব্রত কুমার মল্লিক বলেন,‘ঐতিহাসিক এ বাড়িটি সংরক্ষণ করে এখানে একটি মিউজিয়াম গড়ে তুলতে পারলে এখানে অনেক পর্যটকের আগমন ঘটবে, এলাকার ছেলেমেয়েরা একজন মহীয়সী নারী ও তার সংগ্রামী জীবন  সম্পর্কে জানতে পারবে।’
বাগুটিয়া গ্রামের ১১৬ নং মৌজার ২৩৪৫ দাগের উপর দ্বীতল বাড়িটি যে একজন সংগ্রামী মহীয়সী নারীর বিষয়টি অনেকের কাছে আজও অজানা। তাই বাড়িটি উদ্ধার করে এখানে ইলামিত্র স্মৃতি কমপ্লেক্স গড়ে তোলার দাবি আন্দোলনকারীদের।

বাড়িটিতে বর্তমানে বসবাস করেন হাজি কিয়াম উদ্দীনের পরিবার। তাদের দাবি,ইলা মিত্রের উত্তরাধিকারদের কাছ থেকে তারা বাড়িটি কিনে নিয়েছেন। সুতরাং,তারা বৈধভাবেই বাড়িটিতে বসবাস করছেন। তাদের স্বপক্ষে সব দলিলাদি দেখাতেও তারা প্রস্তুত। তাদের ভাষ্য,তারা টাকা দিয়ে বাড়ি কিনেছেন বসবাসের জন্য। সরকার যদি সেটি অধিগ্রহণ করতে চায় তাহলে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও তাদের সম্মানজনক বসবাসের ব্যবস্থা না করলে তারা ভিটেমাটি হারাবেন।

কিয়ামউদ্দিনের মেজ ছেলে জাহাঙ্গীর আলম জানান,তারা যেন কোনো অবিচার ও অন্যায়ের শিকার না হন,সেদিকে সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

ইলা মিত্রের পৈতৃক বাড়ি সংরক্ষণ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও ইলা মিত্র জন্মবার্ষিকী উদযাপন পরিষদের সদস্য সচিব সুজন বিপ্লব জানান,‘দীর্ঘদিন বসবাসরত পরিবারের সদস্যদের অন্যত্র পুনর্বাসন ও দখলমুক্ত করে সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ না থাকায় বাড়িটির সাথে কালের সাক্ষী কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসও স্মারক স্থানটিও বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছে। অতীতে উপজেলা,জেলা,রাজধানী ঢাকায় কর্তৃপক্ষ বরাবর স্মারকলিপি,মানববন্ধন মিছিল,সমাবেশ ও আন্দোলন কর্মসূচি করেছি।

এবছর ৯৯ তম জন্মবার্ষিকী শৈলকূপা উপজেলা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে। জন্মশতবর্ষের প্রাক্কালে দখলমুক্ত করে ঐতিহাসিক বাড়িটি সংরক্ষণ করা না হলে কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ করে সরকারকে বাস্তবায়নের ঘোষণা আদায়ে অনুষ্ঠিতব্য সমাবেশে দাবি তোলা হবে বলেও জানান তিনি।’

বাড়িটি দখলমুক্ত ও স্মৃতি সংরক্ষণ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন শৈলকুপা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স্নিগ্ধা দাস। তিনি বলেন,‘এ সংগ্রামীর বসতভিটা ও স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করা হবে। যাতে পরবর্তী প্রজন্ম তার গৌরবোজ্জ্বল অতীত মনে রাখতে পারে এবং সেটা থেকে সংগ্রামী মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে।’

শেখ ইমন/ইবিটাইমস 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit exceeded. Please complete the captcha once again.

Translate »