লিবিয়ার বিভিন্ন আটককেন্দ্র থেকে উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশিদের প্রত্যাবাসন অব্যাহত রয়েছে
আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) নতুন করে লিবিয়া ছেড়েছেন এমন ১৭০ জন বাংলাদেশি। এ নিয়ে আড়াই বছরের কম সময়ে সাত হাজারের বেশি বাংলাদেশি দূতাবাস ও আইওএম-এর সহায়তায় দেশে ফিরেছেন।
লিবিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস ১৭০ জন বাংলাদেশি নাগরিককে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)-এর সহযোগিতায় দেশে প্রত্যাবাসন করার কথা জানিয়েছে। দূতাবাসের ফেসবুক পেইজে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রত্যাবাসিতদের আইওএম-এর চার্টার্ড করা বুরাক এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
জানা গেছে, ফেরত পাঠানো ব্যক্তিরা বেনগাজীর গানফুদা ডিটেনশন সেন্টারে বন্দি ছিলেন। দূতাবাস জানিয়েছে, তারা সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও পরিচয় যাচাই-বাছাইয়ের পর আটক অভিবাসীদের অনুকূলে ট্রাভেল পারমিট ইস্যু করে। পরবর্তীতে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ও আইওএম-এর সার্বিক সহযোগিতায় তাদের দেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়।
দূতাবাস সূত্রে আরও জানা গেছে,আগামী ৩০ নভেম্বর ত্রিপলির তাজুরা ডিটেনশন সেন্টার থেকে আরও ১৭৫ জন বাংলাদেশিকে প্রত্যাবাসনের জন্য দূতাবাসের প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে।
মঙ্গলবার ফেরত যাওয়া অভিবাসীদের উদ্দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল আবুল হাসনাত মুহাম্মদ খায়রুল বাশার বলেন, ‘‘বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বৈধ ও নিরাপদ পথই একমাত্র সঠিক উপায়।” মানবপাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে দেশে ফিরে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তাদের প্রতি পরামর্শ দেন তিনি।
দূতাবাসের তথ্য অনুযায়ী শুধু গত মাসেই এক হাজারের বেশি বাংলাদেশিকে লিবিয়া থেকে প্রত্যাবাসন করা হয়েছে। এরমধ্যে ৩০ অক্টোবর পাঠানো হয় ৩১০ জনকে। তাদের মধ্যে মিসরাতা থেকে ২১১ জন এবং ত্রিপলি থেকে ৯৯ জন অভিবাসী ছিলেন।
২৭ অক্টোবর মিসরাতা থেকে ১৭৪ জন বাংলাদেশি নাগরিককে দেশে প্রত্যাবাসন করা হয়। প্রত্যাবাসিত এই অভিবাসীদের মধ্যে ২১ জন তাজুরা ডিটেনশন সেন্টারে আটক ছিলেন এবং অবশিষ্ট ১৫৩ জন মিসরাতা ও পার্শ্ববর্তী শহরগুলোতে বিপদগ্রস্ত অবস্থায় ছিলেন বলে জানিয়েছে দূতাবাস।
এর চারদিন আগে ২৩ অক্টোবর ত্রিপলি থেকে স্বেচ্ছায় দেশে ফেরত যেতে আগ্রহী ৩০৯ জন বাংলাদেশি নাগরিককে প্রত্যাবাসন করা হয়। আর ৯ অক্টোবর পাঠানো হয় ৩০৯ জনকে।
দূতাবাসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুন থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৭,৩৪১ জন বাংলাদেশিকে লিবিয়া থেকে নিজ দেশে প্রত্যাবাসনে সহযোগিতা করেছে দূতাবাস। ত্রিপলির তাজুরা ও বেনগাজীর গানফুদা ডিটেনশন সেন্টারে আটক আরো বাংলাদেশিদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের জন্য চেষ্টা অব্যাহত আছে বলেও জানিয়েছে তারা।
উল্লেখ্য যে, ২০১১ সালে লিবিয়ার প্রয়াত নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর থেকে সেখানে নিরাপত্তাহীনতা এবং বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়। মানবপাচারকারী চক্রের সহায়তায় আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও বাংলাদেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের অনেক অভিবাসী ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে লিবিয়ায় আসতে শুরু করেন। অভিযোগ রয়েছে দেশটিতে আসার পর পাচারকারী চক্রগুলো তাদেরকে আটক করে এবং অত্যাচার, নির্যাতনের পাশাপাশি জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্য করে। দেশে পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের মতো ঘটনাও ঘটছে।
অন্যদিকে ইউরোপে যাওয়ার জন্য অনুপযুক্ত নৌকায় করে বিপদসঙ্কুল সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে অনেক অভিবাসী নিহত বা নিখোঁজ হচ্ছেন।.আইওএম বলছে, চলতি বছর এখন পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরে ১৫শ’ মানুষ নিহত ও নিখোঁজ হয়েছেন। আইওএম-এর ‘মিসিং মাইগ্রেন্টস প্রজেক্ট’ অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ভূমধ্যসাগরে প্রায় ৩৩ হাজার অভিবাসী মারা গেছেন বা নিখোঁজ হয়েছেন।
গত সপ্তাহে লিবিয়ার সমুদ্র উপকূলে অভিবাসনপ্রত্যাশী দুটি নৌকা ডুবির ঘটনায় অন্তত চারজন বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। দুর্ঘটনা কবলিত নৌকা দুটিতে অন্তত একশজন অভিবাসনপ্রতাশী ছিল। লিবিয়ান রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি জানায়, যে নৌকাটির চার জন নিহত হয়েছেন সেটিতে ২৬ জন বাংলাদেশি নাগরিক ছিলেন।
অক্টোবরের শেষে লিবিয়ার উপকূল থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টারত একটি অভিবাসীবাহী নৌকা উল্টে ১৮ জন অভিবাসন প্রত্যাশী মারা গেছেন। এই ঘটনায় বাংলাদেশিসহ অন্তত ৯০ জনকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। এমন অবস্থায় ইউরোপে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়ে এবং দিনের পর দিন লিবিয়ার আটককেন্দ্রগুলোতে বন্দি থেকে অনেক বাংলাদেশি দেশে ফিরে যেতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
উত্তর আফ্রিকার দেশ লিবিয়াতে বর্তমানে ২০ হাজার ৩৯২ জন বাংলাদেশি অবস্থান করছেন। গত মাসে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা রিলিফওয়েবের সর্বশেষ জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, দেশটিতে এই মুহূর্তে বিশ্বের ৪৫টি দেশের মোট আট লাখ ৯৪ হাজার ৮৯০ জন অভিবাসী অবস্থান করছেন। চলতি বছরের মে থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়ে লিবিয়ার ১০০টি পৌরসভায় এই গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়। রিলিফওয়েবের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, লিবিয়াতে বর্তমানে অবস্থানরত অভিবাসীদের মোট দুই ভাগ বাংলাদেশি। সেই হিসাবে দেশটিতে এই মুহূর্তে মোট ২০ হাজার ৩৯২ জন বাংলাদেশি অবস্থান করছেন।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আগত বাংলাদেশিদের শতকরা ৪৬ ভাগ বাংলাদেশ থেকে তুরস্ক হয়ে লিবিয়াতে প্রবেশ করেন। এই পথে তাদের খরচ হয় প্রায় চার হাজার ২৭৭ মার্কিন ডলার। শতকরা ১৪ ভাগ অভিবাসী বাংলাদেশ থেকে প্রথমে আরব আমিরাত এবং সেখান থেকে তুরস্ক হয়ে লিবিয়া প্রবেশ করেন। এই পথে তাদের খরচ হয় প্রায় তিন হাজার ২২৮ ডলার। শতকরা ১৩ ভাগ বাংলাদেশ থেকে প্রথমে আরব আমিরাত তারপর সেখান থেকে মিশর হয়ে লিবিয়াতে প্রবেশ করে। এই পথে তাদের খরচ হয় প্রায় তিন হাজার ৪৯৫ ডলার। আর শতকরা ২৭ ভাগ অন্যান্য পথে লিবিয়াতে প্রবেশ করে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে মিশর, জর্ডান, কাতার, ভারত, সৌদি আরবসহ আরো কয়েকটি দেশ। অর্থাৎ, তারা এর একটি বা কয়েকটি দেশ ব্যবহার করে লিবিয়াতে প্রবেশ করে। এই পথে তাদের খরচ হয় এক হাজার ৬৬২ ডলার।
কবির আহমেদ/ইবিটাইমস





















