নাজিরপুরের শতবর্ষী চিতাই উৎসব

পিরোজপুর প্রতিনিধি: পিরোজপুরের নাজিরপুরে অনুষ্ঠিত হয়েছে শতবর্ষী চিতাই উৎসব। প্রতিবছর এ উৎসব শুরু হয় সন্ধ্যায় আর শেষ হয় পরের দিন সকাল ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে। তবে বিকালে অনুষ্ঠিত ধর্মীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান। আর অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারও শুক্রবার (০৯ ফেব্রæয়ারী) সন্ধ্যায় এ উৎসব শুরু হয়ে শেষ হয়েছে শনিবার (১০ ফেব্রæয়ারী) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে। অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয় উপজেলার সদর ইউনিয়নের কুমারখালী বাজার সংলগ্ন দেবলাল চক্রবর্তীর বাড়িতে। আর ওই উৎসবে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ যোগ দেন।

ওই উৎসবটি হিন্দুধর্মালম্বীদের আয়োজনে হলেও স্থানীয় বিভিন্ন ধর্মের নারী-পুরুষরা অনুষ্ঠান উপভোগ করতে সেখানে আসেন। আর সেখানে থাকা কালী মন্দিরকে কেন্দ্র করে ওই উৎসবের অয়োজন।

ওই মন্দির কমিটির সভাপতি অমৃত লাল দাস জানান, গত প্রায় শত বছরের বেশী সময় ধরে এ চিতই উৎসব চলছে। প্রতি বছরের মাঘের আমাবস্যা তিথিতে কালিমন্দিরে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। দেশের বিভিন্ন স্তান থেকে মন্দিরের ভক্ত সহ বিভিন্ন লোকজন এখানে আসেন। তবে এদের অধিকাংশই তাদের মনবাসনা (মানৎ) পূর্ন করতে বা পূর্ন হলেই এখানে এসে এ চিতই উৎসবে যোগ দেন। আর এদের অধিকাংশই যে সব নারীদের সন্তান হয় না (বন্ধ্যা) তারাই মানৎ করেন। আর সন্তান লাভের পর এখানে চিতই উৎসব করেন।

তিনি আরো বলেন, আমাদের দাদা ও পিতার কাছ থেকে শুনেছি এখানে প্রথম এক কালী মায়ের এক মা তার সন্তান লাভের জন্য মানৎ করেন। তার মনবাসনা পূর্ন হলে তিনি কালী মা (কালী মন্দির) চিতই ভেঁজে খাওয়ান। সে থেকেই এ উৎসব। অর প্রতি বছরই এ উৎসব চলছে। এখন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজারো ভক্ত যোগ দেন।

ওই মন্দিরের দায়িত্বে থাকা পুরোহিত দেবলাল চক্রবর্তী জানান, প্রায় শত বছরের অধিক সময় আগে তার পূর্ব পুরুষ হরষিত আনন্দ চক্রবর্তী ওই উৎসবের আয়োজন করেন। উৎসবে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভক্তরা যোগ দেন। তারা তাদের সনোবাসনা পূর্ন করতে এখানে মানত করেন। আর মনেনাবাসনা পূর্ন হলে এ চিতই উৎসবে যোগ দেন।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, প্রচন্ড শীত উপেক্ষা করে সেখানে হাজারো মানুষের উপস্থিতি। উপস্থিত অনেক দম্পত্তির কোলে রয়েছেন ছোট শিশু সন্তান। সেখানের একটি মাঠে সারি করে পরস্পর ১০৮টি মাটির চুলা তৈরী করা হয়েছে। সেই চুলার উপর সাজানো রয়েছে চিতই পিঠা তৈরীর মাটির সাজ। পাশেই বাজানো হচ্ছে ঢোল-তবলা। ওই মন্দিরের দায়িত্বে থাকা পুরোহিত দেবলাল চুলাগুলোর প্রতিটিতে পর্যাক্রমে লোহার একটি পাত দিয়ে আঘাত, চুলায় থাকা সাজে ফুল ও পরে চুলায় আগুন দিয়ে অনুষ্ঠানের অনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন। এ সময় হিন্দু নারীরা উলু ধ্বনীর মাধ্যমে অনুষ্ঠানের অনুষ্ঠানিকতা শুরু করন। ১০৮ টি চুলায় পর্যাক্রমে পিঠা তৈরিতে অংশ নেন বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বিভিন্ন বয়সের নারীরা। আর উদযাপন কমিটির সদস্যরা ওই পিঠা তৈরীর উপকরন চালের গুড়ার গোলা সরবাহ করছেন।

বাগেরহাট জেলার চিতলমারী উপজেলার রানাপাড়া গ্রামের উৎথান ঘড়ামী জানান, তিনি তার দাম্পত্য জীবনের ১০ বছরে তাদের কোন সন্তান জন্ম না হওয়ায় তারা এখানে মানৎ করায় তারা পুত্র সন্তান লাভ করেন। আর তাই সেই পুত্র সন্তান নিয়েই এখানে আসেন।

একই উপজেলার খলিসাখালী গ্রামের ও উপজেলা সদরের সরকারী বঙ্গমাতা কলেজের প্রভাষক নিত্যানন্দ রায় বলেন, তার স্ত্রীও একই কলেজের প্রভাষক। তাদের দাম্পত্য জীবনের ৫ বছরেও কোন সন্তান জন্ম হওয়ায় তারা এখানে মানৎ করেন। আর সেই মানতে ফলে তারা একটি কন্যা সন্তান লাভ করেন।

একই কথা বলেন গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়া উপজেলার বিউটি গাইন, যশোরের অভয়নগর উপজেলার চেঙ্গুটিয়া গ্রামের সুপ্রিয়া শিকদার।

নাজিরপুর উপজেলা পরিষদের নারী ভাইস চেয়ারম্যান শাহারিয়ার ফেরদাউস রুনা জানান, প্রতি বছর এখানে এ পিঠা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বী সহ বিভিন্ন ধর্মের নারী পুরুষ আসেন। এ অনুষ্ঠান উপভোগ করতে হাজারো দর্শনার্থী দু’তিন দিন আগে থেকে আসতে থাকেন।

নাজিরপুর থানার অফিসার ইন চার্জ (ওসি) মো. শাহ আলম হাওলাদার জানান, সেখানের অনুষ্ঠানটি গত শত বছরের বেশী সময় ধরে সুন্দরভাবে চলে আসছে বলে শুনেছি। সেখানের অনুষ্ঠানের নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ পাঠানো হয়।

এইচ এম লাহেল মাহমুদ/ইবিটাইমস 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit exceeded. Please complete the captcha once again.

Translate »