রাজ্য মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও সাংবিধানিক সুরক্ষার দাবিতে বিগত ছয় বছর ধরে স্থানীয় সিভিল সংগঠনের নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা, অনশন কর্মসূচি চালিয়ে আসছে লাদাখ
আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চল লাদাখের পরিস্থিতি অনেকটাই অপরিবর্তিত রয়েছে। অঞ্চলটিকে আলাদা রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া এবং ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্তির দাবিতে গতকাল বুধবার সেখানে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। এতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়েছেন।
পাকিস্তান ও চীন সীমান্ত সংলগ্ন দিল্লির কেন্দ্র শাসিত সাবেক কাশ্মীরের এই লাদাখ অঞ্চলের ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ আন্দোলন এক সময় পুলিশের বাধায় সহিংসতার রূপ নেয়।
উল্লেখ্য যে,অতীতে বহু অনশন কর্মসূচির নেতৃত্ব দিয়েছেন শিক্ষক সোনাম ওয়াংচুক। এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, এটা তরুণদের এক ধরনের বিস্ফো একটা জেন-জি বিপ্লব। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন আর কাজে আসছে না বলে বিশ্বাস জন্মেছে তাদের মধ্যে। লাদাখে শুরু এই আন্দোলনকে বাংলাদেশ-নেপালসহ সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ায় ঘটে যাওয়া বিপ্লবগুলোর সঙ্গে তুলনা করছেন তিনি।
যেভাবে রক্তক্ষয়ী রূপ নিল লাদাখের ‘শান্তিপূর্ণ’ আন্দোলন: বুধবার সকালে লাদাখ এপেক্স বডির নেতৃত্বে ১৫তম দিনে প্রবেশ করে স্থানীয় আন্দোলনকারীদের অনশন। আগের রাতে দুই প্রবীণ অনশনকারীকে হাসপাতালে নিতে হয়। এরপরই সংগঠকেরা লকডাউনের ডাক দেন। একইসঙ্গে মোদি সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনায় বিলম্ব হওয়ার কারণে ক্ষোভ বাড়তে থাকে।
এ পরিস্থিতিতে আন্দোলনের কেন্দ্র মার্টিয়ার্স মেমোরিয়াল পার্ক থেকে বেরিয়ে স্থানীয় সরকারি ভবন ও বিজেপি কার্যালয়ের দিকে অগ্রসর হন তরুণরা এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান। এতে চারজন নিহত, আরও অনেকে আহত হন। আহতদের মধ্যে একজন আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন।
লাদাখ এপেক্স বডির সমন্বয়ক জিগমাত পালজোর বলেন, এটা লাদাখের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তাক্ত দিন। যারা রাস্তায় দাবি আদায়ে নেমেছিলেন, তাদের হত্যা করা হলো। অন্যদিকে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, অশান্ত তরুণদের সঙ্গে সংঘর্ষে ৩০ জনেরও বেশি পুলিশ আহত হয়েছে। আত্মরক্ষায় গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছে পুলিশ।
মোদি সরকারের অভিযোগ, ওয়াংচুক বিক্ষোভকারীদের উসকে দিয়েছেন। তিনি আরব বসন্তধর্মী আন্দোলন ও নেপালের জেন-জি বিক্ষোভের উল্লেখ করে তরুণদের বিভ্রান্ত করছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
তবে, ওয়াংচুক জোর দিয়ে বলছেন, তিনি কখনোই সহিংসতার আহ্বান জানাননি; বরং সতর্ক করেছিলেন যে দাবিগুলো উপেক্ষা করলে তরুণদের ক্ষোভ ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
উল্লেখ্য যে, ২০১৯ সালে মোদি সরকার জম্মু-কাশ্মিরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা ও রাজ্য পদমর্যাদা বাতিল করে। তখন ওই রাজ্যের তিনটি অঞ্চল ছিল— মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মির উপত্যকা, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু এবং মুসলিম-বৌদ্ধ সমান জনসংখ্যার লাদাখ।
পরে জম্মু-কাশ্মিরকে একটি আইনসভাসহ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এবং লাদাখকে আইনসভাহীন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বানানো হয়। এতে জম্মু-কাশ্মিরের জনগণ অন্তত স্থানীয় নেতাদের নির্বাচিত করার অধিকার পেলেও লাদাখ পুরোপুরি চলে যায় আমলাতান্ত্রিক শাসনের অধীনে।
লাদাখের ৯০ শতাংশ মানুষ ‘তফসিলি জনজাতি’ হিসেবে তালিকাভুক্ত। তাই তারা ভারতের সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় স্বায়ত্তশাসন ও সাংবিধানিক সুরক্ষা চাইছেন, যা উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু অঞ্চলে বিদ্যমান। কিন্তু, লাদাখকে এ পর্যন্ত রাজ্য মর্যাদা কিংবা ষষ্ঠ তফসিলের সুরক্ষা কোনোটাই দিতে রাজি হয়নি মোদি সরকার।
এর ফলে কর্মসংস্থানও কঠিন হয়ে পড়েছে লাদাখের তরুণদের জন্য। আগে জম্মু-কাশ্মির একত্রে থাকায় লাদাখের লোকজনও সেখানকার চাকরিতে আবেদন করতে পারতেন। এখন সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না। ওয়াংচুক বলেন, আমাদের তরুণরা পাঁচ বছর ধরে বেকার। তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এটাই অশান্তির মূল কারণ।
লাদাখ ভারতের হিমালয় সীমান্তে অবস্থিত। চীনের সঙ্গে সরাসরি সীমান্ত রয়েছে অঞ্চলটির। এই অঞ্চলেই গুরুত্বপূর্ণ পাহাড়ি গিরিপথ, বিমানঘাঁটি ও সরবরাহপথ রয়েছে, যা ভারত-চীন যুদ্ধে সামরিক দিক থেকে অপরিহার্য।
২০২০ সালে লাদাখ সীমান্তে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল ভারত ও চীনের সেনারা। তাতে অন্তত ২০ ভারতীয় ও ৪ চীনা সেনা নিহত হয়। এরপর থেকে দুই দেশই সীমান্তে ব্যাপক সেনা মোতায়েন করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিদ্দিক ওয়াহিদ বলেন, ২০১৯ সালে মোদি সরকারের পদক্ষেপ এখন বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে। আগে কাশ্মির ছিল অশান্তির কেন্দ্র, এখন লাদাখও তাতে যোগ হলো।
সর্বশেষ এক বুলেটিনে ভারতের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে লাদাখে আর কোনো সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি। তবে কোথাও চারজনের বেশি মানুষ জড়ো হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
বিক্ষোভে পুলিশের গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে এবং লাদাখের সঙ্গে সংহতি জানাতে আজ ওই অঞ্চলের কারগিল শহরে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
গতকালের সহিংসতায় চারজন নিহত হওয়ার পাশাপাশি ৫০ জনের বেশি মানুষ আহত হন। স্থানীয় বিজেপি কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগসহ ব্যাপক ভাঙচুর চালালে পুলিশ গুলি ছোড়ে।
এক পুলিশ কর্মকর্তা আজ সকালে বলেন, ‘গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে লাদাখের রাজধানী লেহের কোথাও কোনো সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি। নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে এবং পুলিশ সড়কগুলোতে নজরদারি চালাচ্ছে।’
কর্মকর্তারা বলেন, গতকালের সহিংসতার পর পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ওই ঘটনায় চারজন নিহত হওয়ার পাশাপাশি ৫০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। বিক্ষোভকারীদের একটি অংশ সহিংস হয়ে স্থানীয় বিজেপি কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করলে পুলিশ গুলি চালায়।
কারগিল জেলায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। কারগিল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সের (কেডিএ) ডাকে কমপ্লিট শাটডাউন চলছে। সংগঠনটি কারগিলে রাজ্যের মর্যাদা ও ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্তির দাবিতে আন্দোলন চালাচ্ছে। লাদাখের লেহতে একই দাবিতে আন্দোলন করছে লেহ এপেক্স বডি (এলএবি)।
কেডিএ নেতা সাজাদ কারগিলি বলেন, ‘কারগিলে কমপ্লিট শাটডাউন চলছে। লাদাখের লেহতে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এবং সেখানকার মানুষের সঙ্গে সংহতি জানাতেই এ কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়েছে।’ এক ভিডিও বার্তায় সাজাদ মানুষকে ঘরে থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘লাদাখে সহিংসতার কোনো স্থান নেই। আমরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংলাপের মাধ্যমে দাবিগুলো উত্থাপন করতে চাই।’
এদিকে হুররিয়াতের চেয়ারম্যান ও কাশ্মীরের প্রধান ধর্মীয় নেতা মিরওয়াইজ উমর ফারুক লেহতে প্রাণহানির ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি এই ঘটনাকে ২০১৯ সালের ৫ আগস্টের সিদ্ধান্তের ‘পরবর্তী প্রতিক্রিয়া’ বলে অভিহিত করেছেন। সেদিন জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে রাজ্যটিকে জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ—এই দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছিল।
/