ছেলে নেই, তবুও বিছানা গুছিয়ে রাখেন মা

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি :আগের মতোই পাতা রয়েছে বিছানা,আলনায় ঝুলছে ব্যবহৃত কাপড়-চোপড়। কিন্তু,ছেলে নেই,কখনো ফিরবে না তা যেন মেনে নিতে পারছেন না মা রাশিদা খাতুন। সারাক্ষণ নিহত ছেলের ব্যবহৃত জিনিসপত্র নাড়াচাড়া আর স্মৃতি নিয়ে আহাজারি করছেন এই বৃদ্ধা। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পরিবারটি এখন অসহায়, দিশেহারা।

কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঢাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার মির্জাপুর গ্রামের সাব্বির হোসেন (২৩)। কৃষক আমোদ আলী ও রাশিদা খাতুন দম্পতির বড় ছেলে সাব্বির হোসেন। বৃদ্ধ বাবা-মা, ছোট ভাই ও একমাত্র বোনের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন সাব্বির। বোন সুমাইয়া খাতুন স্থানীয় ডিএম কলেজে লেখাপড়া করেন আর ছোট ভাই সাদিক হোসেন স্থানীয় একটি মাদ্রাসার ছাত্র।

সাব্বিরের থাকার ঘরে গিয়ে দেখা গেল আগের মতই বিছানাটি পাতা আছে। আলনায় ঝুলছে তার ব্যবহৃত কাপড়চোপড়। মা রাশিদা খাতুন সারাক্ষণ তার নিহত ছেলের ব্যবহৃত জিনিসপত্র নাড়াচাড়া আর স্মৃতি নিয়ে আহাজারি করেন।

তিনি স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলেন,‘সাব্বিরের মোটরসাইকেল কেনার খুব আগ্রহ ছিল। প্রায়ই বলতো একটি মোটরসাইকেল কিনে দিতে। আমি তাকে বুঝিয়ে বলতাম বোনটাকে আগে বিয়ে দাও। কয়টা গরু পুষেছি। ওগুলো বিক্রি করে মেয়ের বিয়ের খরচ মিটিয়ে তারপর তোমার মোটরসাইকেল কিনে দেব। ঘটনার আগের দিন সন্ধ্যার পর সাব্বির ফোন করেছিল। পরিবারের সব ভাল মন্দ খবর নিয়ে বলেছিল— বেতন হলে টাকা পাঠাবে। সাব্বিরের বাবার বয়স হয়ে গেছে। তিনি এখন কাজ করতে পারেন না। পরিবারের বড় সন্তান সাব্বির সংসারের হাল ধরেছিল। ’

বাবা আমোদ আলী বলেন,‘সাব্বির লেখাপড়ায় খুব একটা এগুতে পারেনি। স্থানীয় আমেনা খাতুন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কয়েক বছর পড়ালেখা করে। তারপর ভর্তি হয় স্থানীয় মাদ্রাসায়। সেখানে কোরআনে ১০ পারা হাফেজ হয় সে। তারপর আর পড়াশোনা করেনি সাব্বির।’
তিনি জানান,৬-৭ বছর আগে ঢাকায় গিয়ে টাইলস মিস্ত্রি হিসেবে কাজ শুরু করে সাব্বির। মাঝে কিছুদিন বাড়িতে ছিল। পরে আবার ঢাকায় গিয়ে উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে অর্গান লিমিটেড কেয়ার নামে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি শুরু করেন।’

জানা গেছে, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৮ জুলাই তুমুল সংঘর্ষ, গোলাগুলি চলছিল উত্তরায়। আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন সাব্বির হোসেন। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে একটি ওষুধের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন তিনি। এ সময় হঠাৎ গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। আন্দোলনকারীরা তাকে কাছের একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরদিন ১৯ জুলাই ভোরে তার লাশ নিজ গ্রামে পৌঁছে। সাব্বিরের লাশ সকাল ১০টার দিকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারীকে হারিয়ে দিশেহারা পরিবারটির সামনে এখন শুধুই অন্ধকার। সন্তানদের পড়াশোনার খরচ, মেয়ের বিয়ে,সংসার খরচ কোথা থেকে আসবে জানা নেই তাদের। তাই তারা সরকারের কাছে আর্থিক সহায়তা চায় অসহায় এই পরিবারটি। সেইসঙ্গে জীবদ্দশায় সন্তান হত্যার বিচারও দেখে যেতে চান বৃদ্ধ এই দম্পতি। আর সরকার যেন তাদের বাড়ির পাশে একটি মসজিদ করে দেয়। যেখানে বসে এলাকাবাসী তাদের ছেলের জন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করতে পারেন এটুকুই চাওয়া সাব্বিরের বাবা মায়ের।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঝিনাইদহের সমন্বয়ক রত্না খাতুন,আনিচুর রহমান জানান,‘তাদের পক্ষ থেকে এই পরিবারটির নিয়মিত দেখভাল করা হচ্ছে। তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য ইতোমধ্যে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।’

শেখ ইমন/ইবিটাইমস 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit exceeded. Please complete the captcha once again.

Translate »