ভারতের প্রতিরক্ষা সচিব ও সম্মিলিত সশস্ত্র বাহিনী প্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় স্বস্ত্রীক নিহত

ভারতের প্রতিরক্ষা সচিব ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়কের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী

আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ ভারতের দক্ষিণের রাজ্য তামিলনাড়ুরতে এই দুর্ঘটনায় ১৪ জন যাত্রীর মধ্যে ১৩ জনই নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েক জন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাও আছেন। আজ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক টুইট বার্তায় হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত জেনারেল বিপিন ও তাঁর স্ত্রী সহ ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েকজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।তিনি তাদের পরিবারের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন।

ভারতের জাতীয় সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছেন, দেশের প্রথম সেনা সর্বাধিনায়ক তথা চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ (সিডিএস) বিপিন রাওয়াত বুধবার দুপুরে ভারতের দক্ষিণের রাজ্য তামিলনাড়ুর  কুন্নুরে নীলগিরি জঙ্গলে আচমকাই তাকে সহ ১৪ জনকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি ভেঙ্গে পড়লে এই দুর্ঘটনা ঘটে।এটি রাশিয়ার তৈরি একটি “এমআই- ১৭” অত্যাধুনিক হেলিকপ্টার এবং একসাথে ২৪ জন যাত্রী বহন করতে পারে।

দুর্ঘটনার পরপরই গুরুতর অগ্নিদগ্ধ আহত অবস্থায় বিপিন রাওয়াতকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।সংবাদ সংস্থা এএনআই সূত্রে খবরে বলা হয়েছে, হেলিকপ্টারের যাত্রী ১৪ জনের মধ্যে ১৩ জনেরই মৃত্যু হয়েছে। এই ১৩ জনের মধ্যেই রয়েছেন বিপিন রাওয়াত ও তাঁর স্ত্রী মধুলিকা এবং কয়েকজন উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা।এখনও জীবিত ভারতীয় বিমান বাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন বরুণ সিংহকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালের আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

ভারতের সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছেন, আজ বুধবার ৮ ডিসেম্বর বেলা ১২টা ৪০ মিনিট নাগাদ নীলগিরির একটি চা বাগানের উপর ভেঙে পড়ে সেনাবাহিনীর এমআই- ১৭ ভি- ৫ হেলিকপ্টারটি।কৃষ্ণস্বামী নামে কুন্নুরের এক বাসিন্দা জানিয়েছেন, প্রথমেই একটি বিকট আওয়াজ পান তিনি। আওয়াজে চমকে উঠে ঘর থেকে বেরোতেই তাঁর চোখে পড়ে একটি হেলিকপ্টার ধাক্কা মারল একটি গাছে। ধাক্কার অভিঘাতে মুহূর্তে আগুন জ্বলে যায় হেলিকপ্টারে। আগুনের গোলার মতো তা ধাক্কা মারে আরও একটি গাছে। কৃষ্ণস্বামীর দাবি, এই ঘটনা দেখে তাঁরা হেলিকপ্টারের দিকে ছুটে যান। যখন তারা সেখানে পৌঁছান, দেখতে পান যে, কয়েকজন দুর্ঘটনাগ্রস্ত হেলিকপ্টারটি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। তাঁদের দেহের সিংহভাগই অগ্নিদগ্ধ ছিল।পরে খবর পেয়েই উদ্ধারকারী দল ঘটনাস্থলে আসেন।

এই দিকে বিপিনের দিল্লির বাসভবনে গিয়ে তাঁর পরিজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংহ।তার কিছুক্ষণের মধ্যেই রাওয়তের সরকারি বাসভবনে ঢুকতে দেখা যায় সেনা প্রধানকে।তাঁর বাড়ির নিরাপত্তাও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জমানায় নিযুক্ত প্রথম সেনাপ্রধান তিনি।স্বাধীন ভারতের সামরিক ইতিহাসে সশস্ত্র বাহিনীর তিন শাখার সর্বাধিনায়ক হওয়ার কৃতিত্বের পালকও জেনারেল বিপিন লক্ষ্মণ সিংহ রাওয়তেরই টুপিতে বলে জানিয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা।

১৯৫৮ সালের ১৬ মার্চ উত্তরাখণ্ডের পৌড়ীর এক গঢ়ওয়ালি রাজপুত পরিবারের জন্ম বিপিনের।তাঁর পরিবারে সেনাবাহিনীতে যোগদানের ইতিহাস পুরুষানুক্রমিক। বাবা লক্ষ্মণ সিংহ রাওয়ত ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল।

পারিবারিক সেই রীতি মেনেই ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন বিপিন রাওয়াত। শিমলার সেন্ট এডওয়ার্ড স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে তিনি যান মহারাষ্ট্রের পুনার খড়কভাসলার ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমিতে। এর পর দেহরাদূনে ইন্ডিয়ান মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে যোগদেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১১ তম  গোর্খা রাইফেলস ব্যাটালিয়নে।

দীর্ঘ কর্মজীবনের বড় অংশ জম্মু ও কাশ্মীরে কাটিয়েছেন জেনারেল রাওয়াত। সোপোরে সন্ত্রাসদমন অভিযান থেকে রজৌরির নিয়ন্ত্রণরেখায় পাক হামলা প্রতিরোধে নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে। পেয়েছেন উত্তম যুদ্ধ সেবা মেডেল, পরম বিশিষ্ট সেবা মেডেল-সহ একাধিক সেনা-সম্মাননা বলে জানিয়েছেন আনন্দবাজার।

আফ্রিকার কঙ্গোয় রাষ্ট্রপুঞ্জের শান্তিসেনার একটি ব্রিগেডের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। মেজর জেনারেল হিসেবে ১৮ নম্বর পদাতিক ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উত্তীর্ণ হওয়ার পর রাওয়াত নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে সেনার ৩ নম্বর কোরের কমান্ডারের দায়িত্ব পান।এর পর হন পুণেয় দক্ষিণাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডের প্রধান। ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন। প্রসঙ্গত, সেনাপ্রধান পদে রাওয়াতের পূর্বসূরি জেনারেল দলবীর সিংহ সুহাগ ২০১৪-র অগস্টে দায়িত্ব নিলেও তাঁর নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছিল মনমোহন সিংহ সরকারের আমলে।

জেনারেল রাওয়াত ভারতীয় সেনাপ্রধান থাকাকালীন কাশ্মীরে পাথর ছোড়া ঠেকাতে এক বিক্ষোভকারীকে জিপে বেঁধে ঘুরিয়েছিল সেনা। সেই পদক্ষেপ সমর্থন করে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন তিনি। এর পর কাশ্মীরে বিক্ষোকারীদের পাথরে সেনাদের আহত হওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘‘পাথরের বদলে ওরা যদি গুলি ছুড়ত, তাহলে আমাদের পক্ষে মোকাবিলা করা অনেক সহজ হত।’’

ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান হিসাবে তিন বছর কাজ করার পর ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর মাসে সেনা প্রধানের পদ থেকে অবসর নেওয়ার কথা ছিল জেনারেল রাওয়াতের। তাঁর এক দিন আগে তাকে দেশের প্রথম সেনা সর্বাধিনায়ক পদে তাঁকে নিযুক্ত করে মোদী সরকার। অর্থাৎ দেশের তিন বাহিনীর সর্বাধিনায়ক।

জেনারেল বিপিন রাওয়াতের  আগে ভারতের দুই প্রাক্তন সেনাপ্রধান কে এম কারিয়াপ্পা এবং শ্যাম মানেকশকে অবসরের পর আলঙ্কারিক ভাবে ফিল্ড মার্শাল পদে উত্তীর্ণ করা হলেও আনুষ্ঠানিক ভাবে স্থল, নৌ এবং বায়ুসেনার সমন্বয় রক্ষার দায়িত্ব পাননি। মোদী সরকার সেনা বিধি সংশোধন করে রাওয়তকেই প্রথম তিন বাহিনীর ‘সিঙ্গল পয়েন্ট অ্যাডভাইজর’-এর দায়িত্ব দিয়েছিল। জল্পনা ছিল, অবসরের আগে রাওয়তকেও পাঁচতারা ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত করা হতে পারে। জীবদ্দশায় সেই সুযোগ পেলেন না জেনারেল বিপিন রাওয়াত।

কবির আহমেদ/ ইবিটাইমস/এম আর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit exceeded. Please complete the captcha once again.

Translate »