অভিশপ্ত ১৫ ই আগস্ট নিয়ে ড. মোঃ ফজলুর রহমানের ধারাবাহিক মতামত। এটি লেখকের নিজস্ব মতামত। এর সাথে ইউরোবাংলা টাইমসের সম্পাদকীয় নীতিমালার সম্পর্ক নেই
শেষ পর্ব
ড. মোঃ ফজলুর রহমানঃ (৮৩) প্রসঙ্গক্রমে বলা আবশ্যক যে, বিএনপি -এর সংসদ সদস্যদের ওয়াক আউটের মধ্য দিয়ে উপরোক্ত কুখ্যাত Indemnity Ordinance বাতিলের নিমিত্তে আনীত বিলটি বিগত ১৯৯৬ সনের ১২ই নভেম্বর জাতীয় সংসদে পাস হয়। ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারকার্য শুরু করার নিমিত্তে রাষ্ট্রীয়ভাবে আরোপিত বাধা অপসারিত হয়। এহেন অবস্থায় সুদীর্ঘ ২১ বছর ধরে আটকে থাকা উক্ত হত্যা মামলাটি সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ে নিষ্পত্তি করার ঐকান্তিক প্রত্যাশায় দেশের কোন একটি স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে অথবা কোন দ্রুত বিচার আদালতে নিষ্পত্তি করার জন্য সচেতন মহল থেকে জোরালোভাবে দাবি উঠতে থাকে। কিন্তু এতদ সংক্রান্ত জনদাবি সচেতনভাবে উপেক্ষা করে সাধারণ আদালতে এবং প্রচলিত নিয়মে বিচারকার্য সম্পন্ন করার জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা অভিমত ব্যক্ত করেন। এমতাবস্থায় অভিযুক্ত সকল আসামীদেরকে তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আইনানুগভাবে প্রাপ্য সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয়। এরই পাশাপাশি মামলা প্রমাণ করার জন্য রাষ্ট্রপক্ষ তাদের অনুকূলে মোট ৬১ জন সাক্ষীদেরকে দিয়ে সাক্ষ্যপ্রদান করেন। বিচারকার্য সম্পন্ন হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ জনাব কাজী গোলাম রসুল বিগত ১৯৯৮ ইং সনের ৮ই নভেম্বর প্রদত্ত রায়ে মোট ১৫ জন আসামীদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ প্রদান করেন। সুতরাং স্বীকৃত মতেই এই হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়াতে বঙ্গবন্ধুকে সাধারণ মানুষের থেকে কোনভাবেই বিচ্যূত করা হয়নি। জাতির পিতা হিসেবে কোন প্রকার বাড়তি সুযোগ-সুবিধা কিংবা কোন প্রকার আনুকূল্য ও প্রদর্শন করা হয়নি।
(৮৪) বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডের রায় হওয়ায় প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী তা অনুমোদনের জন্য ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ নং ধারার বিধান মোতাবেক উক্ত হত্যা মামলার পুরো নথিটি মাননীয় হাইকোর্টে প্রেরণ করা হয়। এমতাবস্থায় ডেথ রেফারেন্স শুনানি শেষে মাননীয় হাইকোর্ট বিভক্ত রায় প্রদান করেন। পরে মাননীয় তৃতীয় বিচারক কর্তৃক প্রদত্ত রায়ে ১২ জন আসামীর মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। ফলে দণ্ডিত আসামীগণ মহামান্য আপীল বিভাগে যথারীতি আপীল দাখিল করেন। কিন্তু ইত্যবসরে ২০০১ সনের ১লা অক্টোবর অনুষ্ঠিত ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্রের কারসাজিতে সরকার পরিবর্তন হয়ে যায়। ফলে উক্ত মামলাটি মহামান্য আপীল বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে বিচারাধীন থেকে যায়। বিচার প্রক্রিয়ার এই পর্যায়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সহিত পরামর্শক্রমে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৯৮ নং অনুচ্ছেদের বিধান মোতাবেক মাত্র একজন অতিরিক্ত বিচারপতিকে আপীল বিভাগে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করলেই আপীল বিভাগের কার্যক্রম অপেক্ষাকৃত স্বল্পতম সময়েই নিষ্পত্তি হয়ে যেত।
(৮৫) এমতাবস্থায় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জনাব মাহমুদুল আমীন চৌধুরী ঐ সময়ে ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের নিকট যথারীতি লিখিতভাবে আবেদন জানান। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রচণ্ড রকমের বৈরী মনোভাবাপন্ন সরকার প্রধান বেগম খালেদা জিয়া এবং তার মন্ত্রীসভার আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহম্মদ -প্রমুখদের কেউই মাননীয় প্রধান বিচারপতির উপরোক্ত আবেদনে কোন সাড়া দেননি। তারা কোন বিভারপতি নিয়োগ করেননি। এই মর্মে কোন কারণ ও তারা ব্যাখ্যা করেননি। এহেন অবস্থায় বিচার প্রক্রিয়ার শেষ পর্যায়ে এসে উক্ত মামলাটি আবারও দীর্ঘদিন ধরে বিচারাধীন থেকে যায়। অধিকারহারা বাঙালি জাতির স্বাধিকার, স্বাধীনতা এবং বাঙালির সামগ্রিক মুক্তি ও কল্যাণের জন্য যে নেতা সারা জীবন ধরে অকুতোভয়ে লড়াই এবং সংগ্রাম করেছেন সেই নেতাকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের বিচার এভাবে আটকিয়ে রাখার ঘটনা যে কোন বিবেচনায় চরম অনৈতিক এবং প্রচণ্ডভাবে অমানবিক বলে জোরালোভাবেই বিবেচিত হয়।
(৮৬) পরবর্তীকালে ২০০৮ সনের ২৯শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয় বারের মতো ক্ষমতায় আরোহণ করেন। তিনি ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় আপীল বিভাগে বিচারাধীন উক্ত মামলাটির বিচারকার্য শুনানী অন্তে যথারীতি নিষ্পত্তি হয়। এহেন নিষ্পত্তি শেষে সর্ব সম্মত রায়ে উপরোক্ত ১২ জন আসামীরই ফাঁসির আদেশ যথারীতি বহাল থাকে। এরই পোষকতায় পদ্ধতিগত সমুদয় কার্যক্রম এবং আনুষ্ঠানিকতা (Procedural all the formalities and obligations) সম্পূর্ণ আইনানুগভাবে যথারীতি সম্পন্ন করা হয়। অতঃপর গত ২০১০ সনের ২৮শে জানুয়ারি ৫ জন আসামীর ফাঁসির দণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত অন্যতম আসামী আজিজ পাশা মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে পলাতক থাকাবস্থায় জিম্বাবুই -তে অবস্থানকালে বিগত ২০০১ সালে ইন্তেকাল করেছে। এছাড়া ভারতে পালিয়ে থাকা অন্যতম আসামী ক্যাপ্টেন মাজেদকে ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারের নিকট হস্তান্তর করায় গত ২০২০ সনের ১১ই এপ্রিল তার ফাঁসির আদেশ ও যথারীতি কার্যকর করা হয়েছে। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত সর্বমোট ১২ জন আসামীদের মধ্যে বাদবাকি ৫ জন আসামী তাদের পরিচয় গোপন করে এবং ঘন ঘন তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে বিভিন্ন দেশে অদ্যাবধি আত্মগোপন করে রয়েছে।
(৮৭) দেশে আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি এবং সংবিধানের মর্যাদা সমুন্নত রাখার পাশাপাশি সপরিবারে জাতির পিতা হত্যার কলংক মোচনের স্বার্থে দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক প্রদত্ত বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার পুরো রায় কার্যকর করা জরুরী এবং আবশ্যক। তাই বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে তাদের জনক হত্যার দায় ও কলঙ্ক থেকে অব্যাহতি এবং অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে হলে যে সমস্ত খুনীরা এখনো কখনো নাম বদল করে আবার কখনোবা ঘন ঘন ঠিকানা তথা অবস্থান পরিবর্তন করে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ছদ্মবেশে আত্মগোপন করে রয়েছে কিংবা পলাতক রয়েছে ইন্টারপোলের সাহায্য নিয়ে সেই সব নরপিশাচ খুনীদেরকে অবিলম্বে ধরে আনার জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। জাতির পিতাকে সপরিবারে এবং ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করার মতো অত্যন্ত গর্হিত, চরম অমানবিক এবং কলঙ্কজনক অধ্যায়টি চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি করতে হলে দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক দণ্ডিত খুনীদেরকে যথাশীঘ্র সম্ভব ধরে এনে উপরোক্ত রায় অনতিবিলম্বে কার্যকর করা আইনসঙ্গত এবং ন্যায়সঙ্গত কারণেই অত্যাবশ্যক এবং অপরিহার্য বটে।
(৮৮) কোন একজন পিতা যতই ব্যর্থ কিংবা অপারগ অথবা হতভাগাই হউক না কেন তিনিও কখনো ভাবতে পারেননা যে তার কোন সন্তানই হবে তার আততায়ী কিংবা হত্যাকারী। বিশাল হৃদয়ের বঙ্গবন্ধু ও তেমনটি ই ভেবেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত বিশ্বস্ত, অনুগত এবং আপাদমস্তক সৎ ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতিক তাজউদ্দিন আহমেদকে বাদ দিয়ে আজীবন জটিল, কুটিল এবং ধুরন্ধর খন্দকার মোশতাক আহমেদকে বঙ্গবন্ধু বাকশালের পলিট ব্যুরোর সদস্য করেছিলেন। সেই মোশতাক বঙ্গবন্ধুর সাথে কোনদিন বেঈমানী এবং মুনাফেকি করবে এটা তিনি কোনদিন কল্পনাও করেননি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সরলতার সুযোগ নিয়ে অতিশয় ধূর্ত এবং চতুর মোশতাক বাঙালির মরণপণ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের সাথে যেমন বেঈমানী করেছেন ঠিক তেমনি ভাবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার এবং তারও পরে স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর সাথেও চরম বেঈমানী এবং বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।
(৮৯) আরও একটি বিস্ময়কর এবং বেদনাদায়ক বাস্তবতা হলো বঙ্গবন্ধুর মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে যাকে মেজর থেকে চার চারটি প্রমোশন দিয়ে তিনি মেজর জেনারেল বানিয়েছিলেন, ভাল মানুষের মুখোশধারী সেই চতুর এবং ক্ষমতালিপ্সু জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর সাথে কোনদিন বেঈমানী কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা করবে এবং তাঁর হত্যাকাণ্ডে অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী এবং কুশীলব হবে এরকম কোন চিন্তা কখনো বঙ্গবন্ধুর ধারণাতেই আসেনি। তাই কোন একজন বাঙালি যতই বেঈমান কিংবা বিশ্বাসঘাতকই হউক না কেন অথবা যতই মুনাফেক কিংবা পাষাণ হৃদয়ের হউক না কেন তাদের কেউই কখনো বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারে কিংবা তাঁর বুকে গুলি চালাতে পারে এরকম কোন ধারণা বঙ্গবন্ধু কোনদিন দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি। আর এহেন অন্ধ বিশ্বাস এবং ধারণাটাই ছিল মহান মুজিবের সবচেয়ে বড় এবং মারাত্মক ভুল। যার খেসারত তাঁকে সপরিবারে জীবন দিয়ে দিতে হয়েছে।
(৯০) বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে যারা সম্যকভাবে খোঁজ খবর রাখেন তারা নিশ্চয়ই জানেন যে, ১৯৭১ এর ২৫শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করার পর পাকিস্তানের স্বৈরাচারী সামরিক সরকার তাঁকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। পরে তাঁকে লায়ালপুর জেলে হস্তান্তর করা হয়। তারও পরে সামরিক আদালতে প্রহসনমূলক গোপন বিচারের মাধ্যমে ১৯৭১ সনের আগস্ট মাসে তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। কিন্তু জাতিসংঘ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ প্রবল আন্তর্জাতিক চাপের কারণে পাকিস্তান সরকার তাদেরই সামরিক আদালতের উক্ত রায় কার্যকর করার সাহস পায়নি। অবিশ্বাস্য এবং অপ্রিয় হলেও সত্য যে, উক্ত রায় হওয়ার চার বছর পরে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে পাকিস্তানেরই অনুচর ও ভাবশিষ্য এবং আপাদমস্তক বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক এবং তারই মতো সুচতুর ও উচ্চাভিলাসী এবং প্রচণ্ড রকমের ক্ষমতালিপ্সু অনুসারী জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ এবং সর্বাত্মক সহযোগিতায় ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ক্ষমতাদর্পী ইয়াহিয়া সরকারের উক্ত রায় বাঙালি নামধারী কতিপয় অবিমৃষ্যকারী নরপিশাচ কার্যকর করে।
(৯১) হাজার বছর ধরে নির্যাতিত, নিপীড়িত এবং চরম বৈষম্যের শিকার বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর নৃশংস এবং নির্মম হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে ‘রক্তাক্ত-শোকাবহ ৩রা নভেম্বর জেল হত্যা দিবস’ উপলক্ষে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে অবস্থিত কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সংযুক্ত হয়ে সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন- “১৫ই আগস্ট এবং ৩রা নভেম্বর জেল হত্যাকাণ্ডের সাথে খন্দকার মোশতাক এবং জিয়াউর রহমান সরাসরি জড়িত।” এছাড়া জিয়াউর রহমান খন্দকার মোশতাকের ডান হাত ছিল বলে ও উপরোক্ত আলোচনায় তিনি জোরালোভাবে উল্লেখ করেন [সূত্রঃ জনগণের ভোটেই ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ- কারও দয়ায় নয়; বিশেষ প্রতিনিধি, দৈনিক জনকণ্ঠ, ৪ঠা নভেম্বর, ২০২০]। বঙ্গবন্ধুর হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী সময়ে খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং জিয়াউর রহমানের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করে জাতির জনকের শোকাহত কন্যা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক আনীত উপরোক্ত অত্যন্ত জোরালো এবং সরাসরি উত্থাপিত অভিযোগ সমূহের সত্যতা, বিশ্বস্ততা এবং যথার্থতা যে কোন প্রকার সন্দেহ (Beyond all reasonable doubt and controversy) ব্যতিরেকেই প্রমাণিত হয়।
(৯২) বিভিন্ন ধরণের ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উৎরাই এবং নানামুখী কূটচাল ও ষড়যন্ত্রের পরেও একথা দিবালোকের মতো সত্য যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাঙালি জাতির জনক। তিনিই আমাদের স্বাধীনতার ঘোষক। জাতির পিতা এবং স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে আমাদের সংবিধানের ১৫০ ও ১৫১ নং অনুচ্ছেদ সহ সংবিধানের ৪র্থ, ৬ষ্ঠ এবং ৭ম তফসিলে সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট (Conspicuously and unequivocally) ভাবে বর্ণিত রয়েছে। বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতার মহান স্থপতি। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের অবিসংবাদিত নেতা। এরই পাশাপাশি তিনি আমাদের মহান মুক্তি সংগ্রামের সর্বোচ্চ নেতা। তাঁর ডাকে এবং আহ্বানেই পরিচালিত হয়েছে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। তাঁর হৃদয়-মন এবং অন্তর জুড়ে ছিল বাংলাদেশ। অন্যভাবে বলা যায় তাঁর বুকটাই ছিল বাংলাদেশ। আপত্য নির্বিশেষে তিনি তাঁর দেশের আপামর জনসাধারণ তথা পুরো বাঙালি জাতিকে ভালবেসেছিলেন। তাই মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু -এই শব্দগুলো এখন সমার্থক হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। তাই যুক্তির নিরিখে এবং বাস্তবতার নিরিখে বলতে গেলে অবশ্যই বলতে হবে বাংলাদেশের অপর নাম শেখ মুজিবুর রহমান।
(৯৩) বাঙালি জাতির অবিনাশী চেতনার মূর্ত প্রতীক বঙ্গবন্ধু। অনেক চড়া মূল্য এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক তিনি। কিন্তু হৃদয় বিদারক হলেও সত্য যে, আমাদের অনুপ্রেরণার অনন্ত উৎস এই মহামানবকে অত্যন্ত নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করা হলো। যা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এই হত্যাকাণ্ডে যারা সরাসরি জড়িত অর্থাৎ যে সব নরপিশাচরা হত্যা করেছে এবং কিলিং মিশনে সশরীরে অংশগ্রহণ করেছে এবং যারা তাদের নিজহাতে গুলি চালিয়েছে শুধুমাত্র সেইসব নরাধম খুনীদেরকে আসামী করেই হত্যা মামলা দাখিল করা হয়েছে। পরে বিচারকার্য সম্পন্ন করার পর তাদেরকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। কিন্তু পৈশাচিক এবং বর্বরোচিত এই হত্যাকাণ্ডের পেছনের রাজনৈতিক শক্তি এবং তাদেরকে পরিচালনাকারী তথা ঠাণ্ডা মাথার ষড়যন্ত্রকারী এবং নেপথ্যের কুশীলবদেরকে চিহ্নিত করা যায়নি। তাই এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত মাস্টারমাইন্ড কে কে এবং তাদের মদদদাতা তথা পৃষ্ঠপোষকতাকারী ও পরামর্শদাতা এবং কুশীলবদেরকে খুঁজে বের করে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা দরকার। সুতরাং দেশ ও জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার নিমিত্তে একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন সর্বদলীয় নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করে নেপথ্যের এইসব ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ জনসমক্ষে উন্মোচন করা দেশ ও জাতির স্বার্থে অত্যন্ত জরুরী এবং অত্যাবশ্যক বলে জোরালোভাবেই বিবেচিত হয়।
(৯৪) ইতিহাসের বরপুত্র, মহাকালের মহানায়ক এবং বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে যদি আমরা প্রকৃত প্রস্তাবেই যথোপযুক্ত সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে চাই তাহলে তাঁর নীতি, আদর্শ, নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ গুলোকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর তা করতে হলে আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশকে অবশ্যই ক্ষুধা, দারিদ্র, সন্ত্রাস এবং বেকারত্বের অভিশাপ মুক্ত করতে হবে। এরই পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক, ধর্ম নিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে জাতি-ধর্ম- বর্ণ নির্বিশেষে আমাদেরকে মনেপ্রাণে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে আত্মনিয়োগ করতে হবে। অভিশপ্ত এবং শোকাভিভূত ১৫ই আগস্টে দেশ ও জাতির কাছে এই হউক আমাদের সুদৃঢ় অঙ্গীকার।
ড. মোঃ ফজলুর রহমান,সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ (অবঃ) , লেখক ও কলামিস্ট
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান।
২। অসমাপ্ত আত্মজীবনী- শেখ মুজিবুর রহমান।
৩। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মারকগ্রন্থ- ১ম, ২য় এবং ৩য় খণ্ড, জ্যোৎস্না পাবলিশার্স।
৪। Witness to surrender- Major Siddik Salik,Oxford University Press, Karachi, 1977.