জার্মানির জাতীয় আইনে যুক্ত হচ্ছে ইইউর অভিন্ন আশ্রয়নীতি

আশ্রয় ও অভিবাসন নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংস্কারগুলোকে নিজেদের জাতীয় আইনে অন্তর্ভুক্ত করছে জার্মানির সরকার

ইউরোপ ডেস্কঃ শনিবার (৬ সেপ্টেম্বর) জার্মানির বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৪ সালে ইইউ জোটভুক্ত দেশগুলো অভিন্ন ইউরোপীয় আশ্রয় ব্যবস্থা গ্রহণে সম্মত হয়৷ সেই অভিন্ন আশ্রয়নীতিকে এবার জাতীয় আইনে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে সম্মত হয়েছে জার্মানির চ্যান্সেলর ফ্রিডরিশ ম্যার্ৎসের সরকার৷

উল্লেখ্য যে, ২০২৬ সালের জুনে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত সবকটি দেশে এই অভিন্ন আশ্রয়নীতি কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে৷ তাই, এর আগেই অভিন্ন আশ্রয়নীতিকে প্রতিটি দেশের জাতীয় আইনে যুক্ত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে ৷ জার্মানির সরকারের মন্ত্রিসভার নেয়া এই প্রস্তাব এখন পার্লামেন্টের আলোচনার মধ্য দিয়ে চূড়ান্তভাবে গৃহীত হবে ৷

কী থাকছে এই অভিন্ন আশ্রয়নীতিতে ? দীর্ঘ অপেক্ষা আর জোটের দেশগুলোর মধ্যে বাগ-বিতণ্ডার পর ২০২৪ সালের ১০ এপ্রিল এই আশ্রয়নীতির অনুমোদন দিয়েছে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট৷ মূলত চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে এটিকে ৷ এগুলোর মধ্যে আছে, বাহ্যিক সীমানা সুরক্ষিত করা, আশ্রয় প্রক্রিয়াকে গতিশীল করা, দায়িত্ব ভাগ করে নেয়া এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারত্বে অভিবাসনকে যুক্ত করা ৷

বাহ্যিক সীমানা সুরক্ষিত করা: যেহেতু বাহ্যিক সীমান্ত হয়েই একজন আশ্রয়প্রার্থী ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রবেশ করে,তাই সেখানেই একজন আশ্রয়প্রার্থীকে প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হবে, তিনি আশ্রয়ের যোগ্য কিনা ৷

এজন্য সীমান্তে স্ক্রিনিং সেন্টারও নির্মাণের কথা বলা হয়েছে৷ যারা ইউরোপীয় ইউনিয়েন প্রবেশের শর্তপূরণে ব্যর্থ হবেন, তাদেরও নিবন্ধনের আওতায় আনা হবে৷ শনাক্তকরণে নেয়া হবে নানা তথ্য৷ বাদ যাবে না স্বাস্থ্য পরীক্ষাও৷ বহিঃসীমান্তে এই কাজ সর্বোচ্চ সাত দিনে শেষ করা হবে৷ আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভেতরে হলে, তা শেষ করা হবে তিন দিনে৷ স্ক্রিনিং শেষে আছে আরো তিনটি ধাপ৷ এগুলো হলো: সীমান্ত, আশ্রয় এবং প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া ৷

ইউরোড্যাক ইইউর একটি বিশেষ ডেটাবেস৷ এর মধ্যে ইউরোপে আসা সব মানুষের তথ্য রাখা হবে৷ আঙুলের ছাপ, মুখের ছাপ, পরিচয়, ভ্রমণ নথি—সব তথ্য সেখানে যুক্ত থাকবে৷ আর সেই তথ্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ভাগাভাগি করা হবে৷ এর মাধ্যমে কতো সংখ্যক মানুষ ইউরোপে এলেন, তার সঠিক তথ্যও পাওয়া যাবে ৷

কোনো আশ্রয়প্রার্থীর যদি সুরক্ষার পাওয়ার সম্ভাবনা কম হয়, তাহলে ‘‘বাধ্যতামূলক সীমান্ত পদ্ধতি’’ প্রয়োগ করা হবে, অর্থাৎ ফেরত পাঠানো হবে ৷ কর্তৃপক্ষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা যারা করবেন কিংবা যাদের নিয়ে নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে বলে মনে করা হবে, তাদের অবশ্যই ফেরত পাঠানো হবে ৷

সীমান্ত প্রক্রিয়ায় সময়ে সুরক্ষায় বিনামূল্যে আইনি পরামর্শ, আপিলের জন্য বিনামূল্যে আইনি সহায়তা এবং বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেয়া হবে৷

গতিশীল আশ্রয় প্রক্রিয়া: নতুন এই উদ্যোগের কারণে আশ্রয় এবং প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সহজ এবং দ্রুততর হবে বলে আশা করা হচ্ছে৷ তবে, সুরক্ষার আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা হবে ৷ আশ্রয়প্রার্থীর আবেদনের পর তা যাচাই-বাছাইয়ে সময়সীমা বেধে দেয়া হবে৷ আশ্রয়প্রার্থীরা ছয় মাস পরে শ্রমবাজারে যুক্ত হতে পারবেন ৷

নিজ দেশে প্রত্যাবাসনে যদি কোনো আশ্রয়প্রার্থীর ঝুঁকি না থাকে, তাহলে তাকে আশ্রয় দেয়া হবে না৷ আন্তর্জাতিক সুরক্ষা অধিকার নিশ্চিত হলেই তিন মাসের মধ্যে বসবাসের অনুমতিপত্র দেয়া হবে ৷

অভিভাবকবিহীন শিশুদের অধিকার সুরক্ষায় আরো জোর দেয়া হবে৷ ইউরোড্যাক ডাটাবেসের মাধ্যমে আশ্রয় আবেদনের সংখ্যা কমানো হবে ৷ অর্থাৎ একবার আশ্রয় চাওয়া ব্যক্তি পুনরায় আশ্রয় চাইতে গেলে তা শনাক্ত করা সম্ভব হবে ৷

সেকেন্ডারি মুভমেন্ট মেনে নেয়া হবে না৷ অর্থাৎ একটি দেশে আশ্রয় চাওয়ার পর কোনো আশ্রয়প্রার্থী যদি আশ্রয় মঞ্জুর হওয়ার আগে অন্য ইইউ দেশে চলে যেতে চান, সেটা গ্রহণ করা হবে না৷ প্রথম যে দেশে তিনি আবেদন করেছেন, সেখানেই তাকে ফেরত পাঠানো হবে৷

সংহতি ও দায়িত্ব ভাগাভাগি: এতদিন ধরে, সংহতি ব্যবস্থা থাকলেও তাতে সবাই সমানভাবে অংশ নিচ্ছিলো না ৷ তাই সংহতির দিকে এবার বেশি মনোযোগ দেয়া হবে৷ গ্রিস, মাল্টা, ইতালি এবং স্পেনের মতো দেশগুলোতেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আশ্রয়প্রার্থী আসেন ৷ তাই এগুলোকে বলা হয় ফ্রন্টলাইনের দেশ ৷

ইউরোপে আগত অভিবাসীদের সব দেশে সমানভাবে ভাগ করে দেয়া হবে৷ কোনো দেশ যদি আশ্রয়প্রার্থীদের গ্রহণে রাজি না হয়, তাহলে সেই দেশকে সেই আশ্রয়প্রার্থীর খরচ বহন করতে হবে ৷

আশ্রয় মঞ্জুর না হওয়া পর্যন্ত একজন আশ্রয়প্রার্থী প্রথম যে দেশটিতে এসেছিলেন, তাকে সেখানেই থাকতে হবে৷ এটি লঙ্ঘন করলে, কোনোভাবে থাকে পূর্ণ সহায়তা দেয়া হবে না৷ শুধু মৌলিক প্রয়োজন মেটানো হবে ৷

আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব: প্রত্যাবাসনের সংখ্যা বাড়াতে তৃতীয় দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তি করবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ মানবপাচার রোধেও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানো হবে৷ মরক্কো, তিউনিশিয়া, পশ্চিম বলকান এবং এশিয়ার দেশগুলোর প্রতি বেশি মনোযোগ থাকবে ৷ অভিবাসী পুনর্বাসনের ক্ষেত্রেও সহযোগিতা দেবে ইইউ ৷

ইউরোপের শ্রমবাজারের ঘাটতি পূরণে আন্তর্জাতিক কর্মীদের নিয়োগে করা হচ্ছে ইউ ট্যালেন্ট পুল নামের একটি প্ল্যাটফর্ম৷ এর মাধ্যমে অভিবাসনে আইনি পথের সুযোগ তৈরি করা হবে ৷

অংশীদার দেশগুলোর নাগরিকদের ইইউতে কাজ, পড়াশোনা এবং প্রশিক্ষণের সুযোগ দেয়া হবে৷ এখন পর্যন্ত মরক্কো, তিউনিশিয়া, মিশর, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সঙ্গে মেধা অংশীদারত্ব চালু করা হয়েছে ৷

‘অভিন্ন আশ্রয়নীতি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক’: জার্মানির সদ্য সাবেক চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসের নেতৃত্বাধীন বিগত জার্মান সরকার গত বছরের নভেম্বরে এই আশ্রয়নীতিকে জাতীয় আইনে যুক্ত করার সিদ্ধান্তে সায় দিয়েছিল ৷ কিন্তু পার্লামেন্টে বিষয়টি পাস হওয়ার আগেই সরকার ভেঙে যায়৷ ফলে, বর্তমান সরকার বিষয়টি পুনর্মূল্যায়ন করে আরেক দফা অনুমোদন দিয়েছে ৷

জার্মানির রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা জেডিএফ-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলেকজান্ডার ডোব্রিন্ডট এই অভিন্ন আশ্রয়নীতিকে ‘‘গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক’’ বলে অভিহিত করেছেন ৷

জার্মানির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলেকজান্ডার ডোব্রিন্ডট এই অভিন্ন আশ্রয়নীতিকে ‘‘গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক’’ বলে অভিহিত করেছেন ৷

তিনি বলেছেন, জোটভুক্ত বেশিরভাগ দেশ ইইউর বাইরে তথাকথিত ‘রিটার্ন হাব’ বা প্রত্যাবাসন কেন্দ্রের সম্ভাবনার দিকে জোর দিচ্ছে৷ তাই এই অভিন্ন আশ্রয়নীতিকে ‘‘শক্তিশালী এবং কঠোর’’ করতে চায় সব দেশ ৷

আগের বছরের তুলনায় আগস্টে জার্মানিতে আশ্রয় আবেদনের সংখ্যা ৬০ ভাগ কমেছে বলেও জানান মন্ত্রী৷ তিনি বলেছেন, সিরিয়া ও আফগানিস্তানের পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এমনটা হয়েছে৷ একইসঙ্গে বর্তমান সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে জার্মানির প্রতি আশ্রয়প্রার্থীদের ‘‘চুম্বকের টান’’ কমে এসেছে বলেও মনে করেন তিনি ৷

কবির আহমেদ/ইবিটাইমস/এম আর 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit exceeded. Please complete the captcha once again.

Translate »