ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে যুক্তরাজ্য পৌঁছানোর প্রচেষ্টায় সপ্তাহান্তে দুই সোমালি নারীসহ তিন অভিবাসী মারা গেছেন
আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর) সকালে ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চলীয় উপকূলের সৈকতে এক তরুণ অভিবাসীর মরদেহ পাওয়া গেছে৷ এটি ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়ার প্রচেষ্টায় মৃত্যুর ক্রমবর্ধমান সংখ্যার সবশেষ ঘটনা বলে জানিয়েছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ৷
এদিন পা-দ্য কালে কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘‘সেন্ট-এতিয়েন-ও-মঁ সৈকতে এক তরুণের মরদেহ পাওয়া গেছে৷ খুব সম্ভবত তিনি গত রাতে গ্রেট ব্রিটেনে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন৷’’তবে মরদেহটির পরিচয়, জাতীয়তা এবং বয়স সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি কর্তৃপক্ষ৷
ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপিকে স্থানীয় প্রসিকিউটর সিসিল গ্রেসিয়ে বলেছেন, এই মৃত্যুর সঙ্গে ঘটনাস্থল থেকে একটু উত্তরের ইকুয়েন-প্লাজ থেকে চ্যানেল পার হওয়ার চেষ্টার কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, তা তদন্ত করে দেখতে হবে ৷
রোববার সকালে ইকুয়েন-প্লাজ থেকে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন অন্তত ৫০ জন অভিবাসী৷ পরে তাদের উদ্ধার করেছে স্থানীয় ফরাসি কর্তৃপক্ষ ৷ তাদের মধ্যে হাইপোথার্মিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ৪৯ বছর বয়সি এক নারী অভিবাসী ৷ তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মঁত্রুই-সুর-মের এলাকার কর্মকর্তা ইসাবেল ফ্রাদিন-থিরোদ ৷
সরকারি তথ্যের ভিত্তিতে বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, এই অভিবাসীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে চলতি বছর চ্যানেল পাড়ি দিয়ে মারা গেছেন অন্তত ২৭ জন অভিবাসী ৷
শনিবার আরো দুই অভিবাসীর মৃত্যু: শনিবার ফরাসি উপকূল বুলোন-সুর-মের উপকূল থেকে চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার চেষ্টারত দুই সোমালি নারী অভিবাসী মারা গেছেন ৷ ফরাসি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুক্রবার রাত থেকে শনিবারের মধ্যে প্রায় ১০০ অভিবাসী একটি ছোট নৌকায় করে উত্তর ফ্রান্স থেকে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে রওনা হন ৷
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, রাতের ওই ঘটনায় অন্তত ৬০ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে৷ তাদের মধ্যে এক দম্পতি ও তাদের শিশু মাঝারি মাত্রার হাইপোথার্মিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন ৷ উদ্ধারের পর তাদের তিন জনকে বুলোন শহরের একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে ৷ বিপজ্জনকভাবে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে গিয়ে চলতি বছর মারা গেছেন অন্তত ২৭ জন।
এদিকে ডানকের্কের পাশের গ্রাভলিন শহরে আরেক অভিবাসীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে৷ তার মৃত্যু কয়েকদিন আগেই হয়ে থাকতে পারে বলে জানিয়েছে ডানকের্ক প্রসিকিউটরের কার্যালয় ৷
ফরাসি কোস্টগার্ডের রেকর্ড অনুযায়ী, গত বছর চ্যানেল পাড়ি দেয়ার চেষ্টায় ৫০ জন অভিবাসী মারা গেছেন৷ চ্যানেল পারাপার শুরু হওয়ার পর ২০২৪ সালই ছিল সবচেয়ে প্রাণঘাতী বছর ৷
ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে অভিবাসীরা যেসব নৌকা ব্যবহার করেন, সেগুলো ছোটো নৌকা নামেই পরিচিত ৷ সমুদ্র অনুপযোগী এই নৌকাগুলো সাধারণত কয়েক মিটার দীর্ঘ হয় ৷ নৌকাগুলোতে প্রায়ই ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি যাত্রী নেয়া হয়৷ যাত্রা শুরু হয় বিশৃঙ্খলভাবে৷ এ কারণেই প্রায়ই দুর্ঘটনার খবর আসে ৷
শনিবার অনুকূল আবহাওয়ার কারণে বেশিসংখ্যক নৌকা ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়ার চেষ্টায় ছিল ৷ সেগুলোর মধ্যে অন্তত ১৪টি যাত্রায় উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করতে হয়েছে বলে জানিয়েছে ফরাসি সমুদ্র কর্তৃপক্ষ প্রেমার ৷ শুধু পা-দ্য-কালে উপকূলে শনিবার সকাল থেকে রোববার পর্যন্ত ২২৩ জন অভিবাসীকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ ৷
এক নৌকায় রেকর্ড ১২৫ অভিবাসী: শনিবার রেকর্ড ১২৫ জন অভিবাসী নিয়ে ফরাসি উপকূল থেকে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে যুক্তরাজ্যে পৌঁছেছে একটি নৌকা ৷ এক নৌকায় অভিবাসীর সংখ্যা আগের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে ৷ এর আগে গত আগস্টে সর্বোচ্চ ১০৬ জন অভিবাসী একটি নৌকায় এসেছিলেন ৷ যা সংবাদ মাধ্যমে ‘মেগা ডিঙ্গি’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল ৷ এদিন, মোট ১২টি নৌকায় ৮৯৫ জন অভিবাসী যু্ক্তরাজ্যে পৌঁছেছেন ৷
ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাবানা মাহমুদ বলেন, ‘‘ছোট নৌকায় এসব পারাপার একেবারেই অগ্রহণযোগ্য এবং এর পেছনে থাকা জঘন্য মানবপাচারকারীরা আমাদের সীমান্তে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে ৷’’
ওয়ান ইন ওয়ান আউট চুক্তির প্রসঙ্গ ধরে তিনি বলেন, ‘‘ফ্রান্সের সঙ্গে আমাদের চুক্তির ফলে এখন ছোট নৌকায় আসা মানুষদের আটক করা সম্ভব হচ্ছে এবং প্রথম দফা প্রত্যাবাসন ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে ৷’’
মন্ত্রী আরও বলেন, ‘‘যুক্তরাজ্যের সীমান্ত রক্ষা করা আমার প্রধান অগ্রাধিকার এবং অভিবাসন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আমি সব ধরনের বিকল্প বিবেচনা করব ৷’’
যুক্তরাজ্য সরকারের ‘ওয়ান ইন, ওয়ান আউট’ চুক্তির আওতায় এর মধ্যে কয়েকজনকে ফ্রান্সে ফেরত পাঠানো হয়েছে ৷ যুক্তরাজ্যে অভিবাসী পাচারে জড়িত চক্রগুলোকে ধ্বংস করা এবং মানুষকে এই বিপজ্জনক যাত্রা থেকে বিরত রাখতেই ফ্রান্সের সঙ্গে অভিবাসী প্রত্যাবাসন বিষয়ক চুক্তিটি করেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ৷
চলতি বছর এখন পর্যন্ত ছোট নৌকায় করে যুক্তরাজ্যে পৌঁছানো অভিবাসীর সংখ্যা ৩৩ হাজার ছাড়িয়েছে ৷ ২০১৮ সাল থেকে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে আসা অভিবাসীদের সংখ্যার হিসাব রাখতে শুরু করেছে যুক্তরাজ্য৷ দেখা গেছে, বছরের এই সময়ের মধ্যে অভিবাসী আগমনের ক্ষেত্রে এটাই সর্বোচ্চ সংখ্যা ৷
যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি এই বিপজ্জনক যাত্রা ঠেকাতে প্রতিনিয়ত সক্ষমতা বাড়াচ্ছে ফ্রান্সও৷ এজন্য অবশ্য যুক্তরাজ্যের আর্থিক সহায়তাও পাচ্ছে তারা৷ কিন্তু কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না এসব যাত্রা
কবির আহমেদ/ইবিটাইমস/এম আর