আবেদনের এগার বছর পর পূর্ব ইউরোপের দেশ রুমানিয়া ও বুলগেরিয়াকে শেনজেন দেশের চুক্তিতে প্রবেশের সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে ইইউ পার্লামেন্ট
ইউরোপ ডেস্কঃ ইউরোপিয়ীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্ট সম্প্রতি জানিয়েছে এই বছর শেষ হওয়ার আগে বুলগেরিয়া এবং রুমানিয়ার জন্য শেনজেন চুক্তিতে যোগদানের আহ্বান জানিয়ে ঘোষণাপত্র গ্রহণ করবে।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টে (ইপি) সম্প্রতি একটি রেজুলেেশন ভোটে পাস হয়েছে, যা বছরের শেষ নাগাদ বুলগেরিয়া এবং রুমানিয়ার শেনজেন অঞ্চলে যোগদানের আহ্বান জানাবে বলে আশা করা হচ্ছে। আলোচ্য রেজুলেশনের পাঠ্যটিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে আগামী বছরের শুরু থেকে দুই দেশের অভ্যন্তরীণ সীমান্তে চেকিং বাতিল করা উচিৎ।
সোফিয়া এবং বুখারেস্ট সম্প্রতি তাদের বাহ্যিক সীমানাগুলির অবস্থা পরীক্ষা করার জন্য একটি নতুন ইইউ মিশনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। যদিও ২০১১ সালে শেনজেনে যোগদানের জন্য তাদের প্রস্তুতি ইতিমধ্যেই ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছিল। ইইউ কাউন্সিলের চেক প্রেসিডেন্সি ডিসেম্বরে ইস্যুটিকে ভোট দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।
শেনজেন চুক্তি কি? শেনজেন চুক্তি হল একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি যা ইউরোপীয় দেশগুলোকে তাদের জাতীয় সীমানা বিলুপ্তি করে দেশগুলোর মধ্যে ব্যক্তিদের অবাধ চলাচলের অনুমতি প্রদান করে। শেনজেন চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল সীমানাবিহীন একটি ইউরোপ তৈরি করতে যা ‘‘শেনজেন এলাকা’’ নামে পরিচিত হবে। ঐতিহাসিক চুক্তিটি লুক্সেমবার্গের শহর শেনজেনে প্রাথমিকভাবে পাঁচটি ইইউ দেশ বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি, লুক্সেমবার্গ এবং নেদারল্যান্ডস কর্তৃক স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এই চুক্তির ফলে, সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ শেষ হয়।
শেনজেন চুক্তি কবে স্বাক্ষরিত হয়? শেনজেন চুক্তি, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি, লুক্সেমবার্গ এবং নেদারল্যান্ডস কর্তৃক ১৪ই জুন, ১৯৮৫- সালে লুক্সেমবার্গে শহর শেনজেনে স্বাক্ষরিত হয়। স্বাক্ষরকারী দেশসমূহ তাদের অভ্যন্তরীণ সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করতে সম্মত হয় এবং শেনজেন এলাকার অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ব্যক্তিদের অবাধ চলাচলের অনুমতি প্রদান করা হয়।
শেনজেন চুক্তির ইতিহাস: ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে অবাধ চলাচলের ধারণাটি অনেক পুরানো। যদিও, আধুনিক সময়ে এই ধারণাটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার পর নেওয়া হয়েছিল। ফ্রান্স এবং জার্মানি মুক্ত চলাচলের ধারণার বিষয়ে প্রাথমিক পদক্ষেপ নিয়েছিল। ১৭ ই জুন, ১৯৮৪ সালে এই দুটি দেশই প্রথম যারা ফন্টেইনব্লুতে ইউরোপীয় কাউন্সিলের কাঠামোর মধ্যে উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলো নিয়ে আসে যেখানে তারা সকলেই নাগরিকদের অবাধ চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তগুলো সংজ্ঞায়িত করার অনুমোদন দেয়।
পরবর্তীতে, ১৪ জুন ১৯৮৫ সালে মোসেল নদীর তীরে দক্ষিণ লুক্সেমবার্গের একটি ছোট গ্রাম শেনজেনে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এতে প্রাথমিক সদস্য বা প্রতিষ্ঠাতা দেশ হিসেবে ছিল যথাক্রমে ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ এবং নেদারল্যান্ডস।
পাঁচ বছর পরে, ১৯ জুন ১৯৯০ সালে, শেনজেন চুক্তির সুনির্দিষ্ট বাস্তবায়নের জন্য একটি কনভেনশন স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এই কনভেনশনে অভ্যন্তরীণ সীমানা নিয়ন্ত্রণের বিলুপ্তি, অভিন্ন ভিসা প্রদানের পদ্ধতির সংজ্ঞা, এসআইএস-বা শেনজেন ইনফরমেশন সিস্টেম নামে পরিচিত সকল সদস্যদের জন্য একটি একক ডাটাবেস পরিচালনা এবং সেইসাথে অভ্যন্তরীণ এবং অভিবাসনের মধ্যে একটি সহযোগিতা কাঠামো প্রতিষ্ঠার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল।
শেনজেন চুক্তি অবশেষে ২৬ মার্চ ১৯৯৫ সালে শেনজেন এলাকা বাস্তবায়ন বা কার্যকর শুরু হয়, যখন সাতটি শেনজেন সদস্য দেশ ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল এবং স্পেন তাদের অভ্যন্তরীণ সীমান্ত চেক বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়।
এইভাবে, ২৮ এপ্রিল ১৯৯৫ অস্ট্রিয়া, ১৯ ডিসেম্বর ১৯৯৬ সালে ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, নরওয়ে এবং সুইডেন যোগদান করে। অক্টোবর ইতালি এবং ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে অস্ট্রিয়া তাদের অভ্যন্তরীণ সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ বাতিল করে।
সর্বশেষ, ফেব্রুয়ারী ২০০৮ সালে, লিকতেনস্টাইন ছিল ২৬তম এবং শেষ দেশ যেটি এখন পর্যন্ত শেনজেন চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। শেনজেন চুক্তি বাস্তবায়নের সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ছিল ডিসেম্বর ২০১১ সালে যখন শেনজেন চুক্তি স্বাক্ষরের তিন বছর পর লিকতেনস্টাইন তার অভ্যন্তরীণ সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ বিলুপ্তির ঘোষণা দেয়।
শেনজেন ভুক্ত দেশ সমূহ: শেনজেন ভুক্ত সর্বমোট দেশ হলো ২৬ টি। নিম্মে শেনজেন দেশের তালিকা দেওয়া হল। বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, পর্তুগাল এবং গ্রীস, ইতালি, অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, নরওয়ে সুইডেন,চেক রিপাবলিক, এস্তোনিয়া, হাঙ্গেরি, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, মাল্টা, পোল্যান্ড,স্লোভাকিয়া এবং স্লোভেনিয়া অন্তর্ভুক্ত।
২০০৮ সালে সুইজারল্যান্ড এবং ২০০৮ সালে লিকতেনস্টাইন যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে শেনজেন এলাকা আরো বিস্তৃত রুপ লাভ করে। শেনজেন ভুক্ত ২৬ টি দেশের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের(EU) দেশ রয়েছে ২২টি এবং ইইউর বাহির থেকে রয়েছে ৪টি (চার) দেশ যথাক্রমে আইসল্যান্ড, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড এবং লিকতেনস্টাইন।
এদিকে ইইউর পার্লামেন্ট থেকে একটি বিশ্বস্ত সূত্র ইউরোপের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছে, রুমানিয়া ও বুলগেরিয়ার পর শেনজেনে প্রবেশ করতে যাচ্ছে ক্রোয়েশিয়া।
কবির আহমেদ/ইবিটাইমস