কবির আহমেদ, ব্যুরো চিফ, অষ্ট্রিয়াঃ তাইওয়ান আনুষ্ঠানিকভাবে চীন প্রজাতন্ত্রের স্বায়ত্তশাসিত দেশ। তাইওয়ান পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ, উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরের সংযোগস্থলে, উত্তর-পশ্চিমে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন, উত্তর-পূর্বে জাপান এবং ফিলিপাইন।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ সংস্থা ভয়েস অফ আমেরিকা (VOA) জানিয়েছে,চীন বুধবার স্বায়ত্তশাসিত তাইওয়ানকে তার নিয়ন্ত্রণে আনতে সামরিক শক্তি ব্যবহার করার হুমকি পুনর্ব্যক্ত করেছে। তাইওয়ানের চতুর্দিকে চীনের বর্তমান বিশাল সামরিক মহড়া কয়েক বছরের মধ্যে উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
মন্ত্রিপরিষদের তাইওয়ান বিষয়ক কার্যালয় এবং এর সংবাদ বিভাগের জারি করা বিবৃ্তিতে জানা যায় যে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চীনা যুদ্ধজাহাজ এবং বিমান বাহিনীর বিমানগুলি তাইওয়ানের জলসীমা ও আকাশসীমায় ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ এবং অনুপ্রবেশ চালিয়ে যাচ্ছে। এই পদক্ষেপগুলি বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইনগুলির জন্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলটিতে ফ্লাইট এবং শিপিংকে ব্যাহত করেছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং অন্যান্যরা এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।
চীনা বিবৃতিতে বলা হয়, বেইজিং “সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করবে এবং শান্তিপূর্ণ পুনঃএকত্রীকরণের জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। কিন্তু আমরা শক্তি প্রয়োগ বন্ধ করব না। বাহ্যিক হস্তক্ষেপ এবং সমস্ত বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপের বিপক্ষে আমরা সমস্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার অধিকার রাখি ।”
চীন বলছে, গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের কারণে এই হুমকিমূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু তাইওয়ান বলছে, এ ধরনের সফর নিত্যনৈমিত্তিক এবং চীন তা কেবল তাদের হুমকি বৃদ্ধি করার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে। তাইওয়ানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মঙ্গলবার সতর্ক করে দিয়ে বলেন, যেসময় তাইপেই নিজেদের রক্ষা করার জন্য অনুশীলন পরিচালনা করে ঠিক তখনই চীনের সামরিক মহড়া পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বড় অংশনিয়ন্ত্রণের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকেই প্রতিফলিত করে।
তাইপের প্রধান পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্রও বেইজিংয়ের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তাইওয়ানের সাথে ওয়াশিংটনের কোনও আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই বলে জানায়।
চীনের মহড়ার প্রতিক্রিয়ায়, তাইওয়ান তার বাহিনীকে সতর্ক করে দিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত সক্রিয় পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত রয়েছে।
তাইওয়ানের ইতিহাস থেকে জানা যায়,প্রায় ৬,০০০ বছর আগে এই দ্বীপে প্রথম মানুষের আগমন ঘটেছিল। ১৭ শতকে আংশিক ওলন্দাজ দ্বারা দখলের কারণে হান চীনারা এখানে আসতে পারে। তাইওয়ানের দক্ষিণ-পশ্চিম কিছু সময় তুংগিং রাজ্য দ্বারা শাসনের পরে ১৬৮৩ সালে চীনের কিংগ রাজবংশ দখল করে নেয়। যা জাপান রাজ্যের কাছে ১৮৯৫ সালে সমর্পন করে। চীন প্রজাতন্ত্র কিংগ রাজবংশকে ১৯১১ সালে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করে। ১৯৪৫-এ জাপানের সমর্পনের পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্রদের পক্ষ থেকে তাইওয়ানের দখল নেয় চীন প্রজাতন্ত্র।
চীন গৃহযুদ্ধের কারণে চীন প্রজাতন্ত্র চীনের মূল ভূ-খন্ড চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কাছে হারায় ও ১৯৪৯-এ তাইওয়ানে পালিয়ে যায়। যদিও চীন প্রজাতন্ত্র বলতে থাকে তারাই চীনের আসল প্রতিনিধি, ১৯৫০ থেকেই তাদের আসল আইনগত এলাকা তাইওয়ান ও এর কাছাকাছি ছোট দ্বীপের কাছাকাছি সীমাবদ্ধ হয়।
সাধারণত প্রজাতন্ত্রী চীন-শাসিত এলাকা বোঝাতেও “তাইওয়ান” ব্যবহৃত হয়। প্রজাতন্ত্রী চীন প্রশান্ত মহাসাগরের তাইওয়ান দ্বীপ, অর্কিড আইল্যান্ড, শাসন করে থাকে। এছাড়া পিশকাদোরিশ (পর্তুগিজ: Pescadores প্যিশ্কাদ়োর্যিশ্ অর্থাৎ “মৎস্যজীবীগণ”), কিনমেন, ফুচিয়েন তীরবর্তী মাৎসু আইল্যান্ড প্রভৃতি দ্বীপও শাসন করে। তাইওয়ান ও ফেংহু দ্বীপপুঞ্জগুলো (তাইপে ও কাওসিউং পৌরসভা বাদে) প্রজাতন্ত্রী চীনের তাইওয়ান প্রদেশ হিসেবে প্রশাসিত হয়।
১৯৬০ দশকের শুরু থেকে তাইওয়ান দ্রুত অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও শিল্পায়ন করতে থাকে যা “তাইওয়ান মিরাকেল” নামে পরিচিত। ১৯৮০-র দশকের শেষ থেকে ১৯৯০-র দশকের শুরুতে চীন প্রজাতন্ত্র একদল স্বৈরশাসন থেকে বহুদল বিশিষ্ট অর্ধ-রাষ্ট্রপতি শাসিত গণতন্ত্রের দিকে যায়। তাইওয়ানের রপ্তানিমুখী শিল্প জিডিপি হিসেবে পৃথিবীর ২১তম বৃহত্তম ও পিপিপি হিসেবে ২০তম। যার বেশিরভাগই লোহা, যন্ত্রপাতি, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও রসায়ন শিল্প। তাইওয়ান একটি উন্নত দেশ। জিডিপির দিক থেকে ১৫তম। রাজনীতি, মানবাধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মানব উন্নয়ন বিষয়ে অত্যন্ত উন্নত।
তাইওয়ানের রাজনৈতিক স্বায়ত্ত্ব বিবাদের বিষয়বস্তু। ১৯৭১-এ “চীন মানুষের প্রজাতন্ত্র” দ্বারা সরানোর পরে, চীন প্রজাতন্ত্র বর্তমানে আর জাতিসংঘের সদস্য নয়। “চীন মানুষের প্রজাতন্ত্র” তাইওয়ানকে নিজেদের বলে দাবি করে এবং যারা তাইওয়ান সরকারকে মেনে নেয় তাদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখে না। তাইওয়ান ১৯৩ জাতিসংঘ সদস্যের মধ্যে ১৪ জনের এবং “হলি সি”-র সাথে রাষ্ট্রীয় কূটনৈতিক যোগাযোগ রাখে। অনেক দেশ অরাষ্ট্রীয়ভাবে তাইওয়ানের সাথে প্রতিনিধি অফিস ও সংস্থা দিয়ে যোগাযোগ রাখে, যা আসলে পররাষ্ট্র কেন্দ্রের মতই কাজ করে।
যেসব সংস্থায় চীন আছে তারা হয় তাইওয়ানকে সদস্যতা দেয়না অথবা দেশহীন অবস্থায় যোগ দিতে দেয়। তাইওয়ান বিশ্ব ব্যবসা সংঘ, এশিয়া-প্যাসিফিক অর্থনৈতিক সংঘ ও এডিবি-তে বিভিন্ন নামে সদস্য। আঞ্চলিকভাবে মূলত চীনের সাথে একতাবদ্ধ হওয়া আর তাইওয়ানের আলাদা জাতিত্ব এই দুইভাগে রাজনীতি বিভক্ত। কিন্তু উভয় পক্ষই বৃহত্তর জনগোষ্ঠির সমর্থন পাওয়ার জন্য নিজেদের অবস্থান সংযত করেছে।
ইবিটাইমস/আরএন